বিজ্ঞাপন

শিক্ষার্থী বেশি দেখিয়ে বরাদ্দ নয় ছয়— সমাজসেবার কাণ্ড!

August 14, 2023 | 2:44 pm

ইমরান চৌধুরী, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট

চট্টগ্রাম ব্যুরো: চট্টগ্রাম নগরীতে প্রতিবন্ধীদের দুটি বিশেষায়িত স্কুলের শিক্ষার্থী সংখ্যা দিন দিন কমলেও নথিপত্রে বেশি দেখানোর অভিযোগ উঠেছে। কিন্তু কেন এই গরমিল? অনুসন্ধান বলছে, সরকারিভাবে বরাদ্দ টাকা হাতিয়ে নিতেই এ ‘চালবাজি’, যার সঙ্গে জড়িত সমাজসেবা অধিদফতরের কর্মকর্তা থেকে শুরু করে স্কুলে কর্মরত শিক্ষকরাও।

বিজ্ঞাপন

জানা গেছে, ২০২১ সালেও যেখানে দৃষ্টি প্রতিবন্ধীর সংখ্যা ছিল ৩০, সেটা গিয়ে এখন ঠেকেছে আট জনে। অথচ বরাদ্দ আনা হচ্ছে ২৪ জনের নামে।

স্কুলের প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, প্রতিবন্ধী স্কুলের শিক্ষার্থীদের জন্য সরকার থেকে আসা বরাদ্দ টাকা ভাগ–বাটোয়ারার জন্য শিক্ষার্থীশূন্য করা হচ্ছে বিদ্যালয়টিকে। শিক্ষার্থী না থাকার পরও অতিরিক্ত শিক্ষার্থী আবাসিক দেখিয়ে বিল করা হয়।

অন্যদিকে, অনাবাসিক দৃষ্টি-প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের শিক্ষা সামগ্রীও দেওয়া হয় না। শিক্ষার্থীদের জন্য থাকার ভবনের নাম দিয়ে সমাজসেবা অধিদফতরের কর্মকর্তারা নিজেদের অফিস বানিয়েছেন। বিদ্যালয় দু’টিতে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদানের অনুমতি আছে। তবে অন্যান্য বিদ্যালয়ে পড়ুয়া দশম শ্রেণি পর্যন্ত আবাসিক সুবিধা পেয়ে আসছিল প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরা। কিন্তু সেটা এখন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

একই ভবনে সমাজসেবা অধিদফতরের অধীন পরিচালিত বাক্‌ ও শ্রবণপ্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ের বিরুদ্ধেও রয়েছে একই ধরনের অভিযোগ। এ ছাড়া লেখাপড়ার সুবিধার্থে বিভিন্ন এনজিও থেকে দেওয়া স্মার্টফোনও নিয়ে নেওয়ার অভিযোগ আছে স্কুল কর্তৃপক্ষের ওপর।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, নগরীর মুরাদপুরে একই ভবনে অবস্থিত বিদ্যালয় দু’টিতে আদতে মোট শিক্ষার্থী ৪০ জন। এর মধ্যে আবাসিক শিক্ষার্থী রয়েছে সব মিলিয়ে ২৩ জন। কিন্তু আবাসিকে কখনও দেখানো হয় ৪৭ জন, আবার কখনও ৫৭ জন। প্রতিজন আবাসিক শিক্ষার্থীর জন্য মাসে ভাতা পাওয়া যায় ৩ হাজার ৬০০ টাকা। সে হিসেবে মাসে এক লাখ ৬৯ হাজার ২০০ টাকা সরকার থেকে বরাদ্দ পাওয়ার কথা। অর্থাৎ মাসে কমপক্ষে ৮৬ হাজার ২০০ টাকা ‘হাওয়া’ হয়ে যাচ্ছে।

রোববার (১৩ আগস্ট) সরেজমিনে দেখা যায়, ১৫ জন বাক্‌–শ্রবণ ও পাঁচ জন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী ক্লাস করছে। এর মধ্যে আবাসিক শিক্ষার্থী ১৮ জন। আবাসিক শিক্ষার্থীদের ছাত্রাবাসে ঢুকতে চাইলে ভবনের দায়িত্বে থাকা দারোয়ান সারাবাংলার এই প্রতিবেদককে ঢুকতে দেননি।

বিজ্ঞাপন

আল আমিন নামের এই বিদ্যালয়ের এক প্রাক্তন শিক্ষার্থী সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা যখন ওই স্কুলে ছিলাম তখন দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের সংখ্যা ছিল ৩০ থেকে ৪০ জন। সেটা এখন ১০-এ নেমে এসেছে। সামনে আরও কমবে। আগে দশম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা আবাসিকে থাকতে পারতো, সেটাও বন্ধ করে দিয়েছে। আমরা অনেক প্রতিবাদ করেছি। কতৃপক্ষ সেটা কানে নেয়নি।’

সোহেল রানা নামের আরেক প্রাক্তন শিক্ষার্থী সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রতিবন্ধীদের চলাফেরা করতে নানারকম অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়। তাই আমাদের মতো শিক্ষার্থীদের জন্য আবাসিক সুবিধা রাখা অনেক প্রয়োজন। আগে ওই স্কুলে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরা পড়ার সুযোগ পেত। তবে সেটা এখন পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত করা হয়েছে। যারা ওই স্কুলের শিক্ষার্থী তারা আবাসিকে থাকতে পারছেন। আর অন্যদের বের করে দেওয়া হয়েছে। বাকিরা কোথায় পড়বে? কোথায় যাবে?’

তন্ময় দত্ত নামে আরেক প্রাক্তন শিক্ষার্থী বলেন, ‘সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলটির রেজিস্ট্রেশন আছে। তবে কেন সেখানে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ক্লাস করানো হচ্ছে সেটা বোধগম্য হচ্ছে না। আবাসিকে মেয়েদের জন্য যে হোস্টেল ছিল সেটা ভেঙে অফিসারদের জন্য অফিস বানিয়েছে। ছেলেমেয়েরা তাহলে থাকবে কোথায়? তাই তারা শিক্ষার্থী শূন্য করতে আবাসিকে শিক্ষার্থীদের রাখছে না। কারণ, আবাসিক সুবিধা না থাকলে দূর-দূরান্ত থেকে শিক্ষার্থীরা পড়তে আসবে না। আর এতে তাদের লাভ।’

জানতে চাইলে সমাজসেবা অধিদফতরের চট্টগ্রাম জেলার সহকারী পরিচালক ও স্কুলটির তত্ত্বাবধায়ক কামরুল পাশা ভূঁইয়া সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের স্থায়ী কোনো ভবন নেই। এটা জেলা কমপ্লেক্স। অনেক বলে-কয়ে চতুর্থ তলায় চারটি রুম পেয়েছি। এখানেই কোনোভাবে স্কুলের কার্যক্রম পরিচালনা করতে হচ্ছে। ফিলিস্তিনিদের মতো অবস্থা হয়েছে আমাদের।’

বিজ্ঞাপন

তিনি বলেন, ‘আমি একটি ছেলেকেও বের করিনি। তবে হ্যাঁ সরকারি নীতি অনুযায়ী নিয়মকানুনে কিছুটা পরিবর্তন এনেছি। এটার জন্য আমি সবার কাছে চক্ষুশূল হয়ে পড়েছি। যতজন শিক্ষার্থী আছে তার বাইরে এক টাকাও বরাদ্দ থেকে নেওয়া হয় না। কেউ কেউ পড়াশোনা না করে সারারাত স্মার্টফোন চালাতো, তাই সেগুলো নিয়ে নেওয়া হয়েছিল। অনেকের ফোন ফেরতও দিয়েছি।’

আবাসিক ও অনাবাসিক শিক্ষার্থীর তালিকা চাইলে তিনি জানান, স্কুলে বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী এবং দৃষ্টি প্রতিবন্ধী সব মিলিয়ে শিক্ষার্থী আছে ১০২ জন। এর মধ্যে আবাসিক ৪৭ জন ও অনাবাসিক ৫৫ জন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সমাজসেবা অধিদফতরের বিভাগীয় সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ শাহী নেওয়াজ সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি শেষবার গিয়ে আবাসিকে ২৩ জন শিক্ষার্থীর তথ্য পেয়েছি। এর মধ্যে ১৫ জন বাক-শ্রবণ এবং আট জন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদানের অনুমতি থাকলেও আগে দশম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা ছাত্রাবাসে থাকা-খাওয়ার সুযোগ পেত। এখন সেটা বন্ধ। কেন বন্ধ, সেটা আমি বলতে পারব না।’

১০২ জন প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীর জন্য নেই কোনো প্রধান শিক্ষক

সমাজসেবা অধিদফতরের অধীন পরিচালিত বিদ্যালয় দু’টিতে এখন কোনো প্রধান শিক্ষক নেই। সরেজমিনে দেখা গেছে, তিনটি কক্ষে শিক্ষার্থীদের বসিয়ে রাখা হয়েছে। এর মধ্যে একই কক্ষে বাক-শ্রবণ প্রতিবন্ধীদের ক্লাস নিচ্ছেন দু’জন শিক্ষক। অন্য দু’টি ক্লাসে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরা বসে আছেন। জানতে চাইলে তাদের মধ্যে এক শিক্ষার্থী সারাবাংলাকে বলেন, ‘স্যার নেই। বড় স্যারের সাথে মিটিং করতে গেছেন।’

সমাজসেবা অধিদফতরের কর্মকর্তা কামরুল পাশা ভূঁইয়া সারাবাংলাকে বলেন, ‘স্কুলে ১০ জন শিক্ষক থাকার কথা। কিন্তু শিক্ষক আছে মাত্র দু’জন। আরও দু’জন সামনের মাসে জয়েন করবে। এটি সত্য যে, একটি স্কুলেও প্রধান শিক্ষক নেই। এটার জন্য আমরাও ভুগছি। এর সমাধান খুব দ্রুতই হবে।’

সারাবাংলা/আইসি/পিটিএম

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন