বিজ্ঞাপন

আশা জাগিয়ে শেষ হলো ন্যাপ এক্সপো

April 25, 2024 | 11:55 pm

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর একটি বাংলাদেশ। দেশের উপকূলীয় অঞ্চল বিলীন হয়ে যাচ্ছে সাগরের সীমানায়। লবণাক্ততার প্রভাব পড়েছে সুপেয় পানি, কৃষি, যোগাযোগ ও অভিবাসনে। বন্যা, তীব্র তাপপ্রবাহ, অনাবৃষ্টি, ঘূর্ণিঝড়ের মতো পাকৃতিক দুর্যোগের প্রভাবেও ব্যাহত হচ্ছে অগ্রযাত্রা। বৈশ্বিক উষ্ণতাসহ জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবগুলোর পেছনে দায় কম হলেও এগুলোর প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হচ্ছে বাংলাদেশকেই।

বিজ্ঞাপন

জলবায়ু পরিবর্তনের এসব প্রভাব মোকাবিলা করে কার্যকর অভিযোজনের জন্য যে বিপুল অর্থ প্রয়োজন, বৈশ্বিক জলবায়ু ফোরামগুলোর মাধ্যমে বিতরণ করা হয় সেই অর্থ। ন্যাশনাল অ্যাডাপটেশন প্ল্যান (ন্যাপ) এক্সপো ২০২৪ আয়োজনের মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সেই অর্থের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্বই তুলে ধরা হলো আন্তর্জাতিক মহলের কাছে। বিশ্বের ১০৪টি দেশের অংশগ্রহণে এই এক্সপোতে বাংলাদেশ তুলে ধরেছে নিজেদের সক্ষমতা, শক্তি ও পরিকল্পনা। বাংলাদেশ আশা করছে, আগামী কপ (কপ-২৯) সম্মেলনে এসব বিষয় অগ্রাধিকার পাবে।

গত সোমবার (২২ এপ্রিল) শুরু হয়েছে ন্যাপ এক্সপো শেষ হয়ে গেল বৃহস্পতিবার (২৫ এপ্রিল)। রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আয়োজিত এই এক্সপোতে অংশগ্রহণকারী দেশি-বিদেশি অতিথিরাও বলছেন আশার কথা। একে অন্যের সঙ্গে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার অভিজ্ঞতা বিনিময়ের মাধ্যমে কীভাবে তারা উপকৃত হয়েছেন, সেসব বিষয়ট উঠে এসেছে নানা কথোপকথনে।

জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংগঠন ইউএনএইচসিআরের প্রধান কার্যালয় থেকে ন্যাপ এক্সপোতে যোগ দিতে ঢাকায় এসেছিলেন ক্লাইমেট অ্যাকশন টিমের মিশেল ইউনেতানি। এক্সপো নিয়ে মুগ্ধতা জানিয়ে তিনি বলেন, এখানে একই ছাদের নিচে বিভিন্ন দেশ থেকে আসা অংশগ্রহণকারীরা নিজেদের মধ্যে দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা বিনিময় করেছে। এটি সত্যিই মূল্যবান।

বিজ্ঞাপন

ইথিওপিয়ার পরিবেশ অধিদফতরের তরুণ কর্মকর্তা সিমরান। এক্সপো শেষে সারাবাংলার সঙ্গে কথোপকথনে তিনি বলেন, বাংলাদেশের মতো আমাদের দেশও জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার। এখানেও অতিমাত্রায় খরা, বন্যা, বাস্তুচ্যুতি, সংঘর্ষ ইত্যাদির মতো সমস্যার মোকাবিলা করছি। এসব মোকাবিলার জন্য আমাদের দেশে প্রতি ছয় বছর পরপর জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা (ন্যাপ) গ্রহণ করা হয়। আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সবচেয়ে অরক্ষিত ক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত করে সেগুলো সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপ নিই। তবে অর্থ সংকটসহ নানামুখী চ্যালেঞ্জের জন্য আমরা জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারছি না।

‘সব দেশের নিজ নিজ অভিজ্ঞতা ও চ্যালেঞ্জ থাকে। চমৎকার এই এক্সপোতে নিজেদের ভালো ও খারাপ অভিজ্ঞতা বিনিময় করলাম। কীভাবে কোন পদ্ধতি অবলম্বন করে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারব, সেগুলো নিয়ে আলোচনা করলাম,’— বলেন সিমরান।

বিজ্ঞাপন

বৃহস্পতিবার (২৫ এপ্রিল) সমাপনী অনুষ্ঠানে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. ফারহিনা আহমেদ বলেন, ন্যাপ এক্সপোতে জাতীয় পরিকল্পনার মাধ্যমে রূপান্তরমূলক অভিযোজন নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। অভিযোজন পরিকল্পনার জন্য একটি নতুন পদ্ধতির প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে এবং বিভিন্ন উৎস থেকে অর্থের নিরাপত্তা নিশ্চিতে আলোচনা করা হয়েছে। এক্সপো অভিজ্ঞতা ভাগ করে নেওয়ার একটি প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করেছে। সামগ্রিকভাবে ইভেন্টটি অভিযোজন পরিকল্পনায় বাংলাদেশের নেতৃত্বশীল ভূমিকার ওপর জোর দিয়েছে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় কার্যকর কৌশল সম্পর্কেও আলোচনা হয়েছে।

পরিবেশ সচিব তৃণমূল পর্যায়ে, বিশেষ করে স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে (এলডিসি) বাস্তব সমস্যা সমাধানের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন, যেখানে ন্যাপ বাস্তবায়নের জন্য অর্থের অ্যাকসেস এখনো চ্যালেঞ্জিং। ন্যাপ এক্সপো ন্যাপের অগ্রগতি মূল্যায়ন ও এগিয়ে যাওয়ার কৌশল নির্ধারণের একটি প্ল্যাটফর্ম। তিনি ন্যাপ এক্সপোর ফলাফলকে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দিতে কপ ২৯-এ একটি ইভেন্ট আয়োজনের প্রস্তাব করেন।

এ সময় সচিব আবারও জলবায়ু অভিযোজন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় সম্পদ ও প্রযুক্তি প্রদানের প্রতিশ্রুতি পূরণের জন্য উন্নত দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানান।

এর আগে সোমবার (২২ এপ্রিল) ন্যাপ এক্সপোর উদ্বোধনী দিনে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী বলেছিলেন, এখান উন্নত বিশ্বসহ এখানে ১০৪টি দেশের প্রতিনিধি আছেন। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বাংলাদেশের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ, সেই বার্তা আমরা স্পষ্টভাবে দিয়েছি। কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। আমাদের দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে।

বিজ্ঞাপন

জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত জাতিসংঘের ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন সচিবালয়ের অভিযোজন বিভাগের ব্যবস্থাপক ডা. পল ডেসাঙ্কার ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র ও বাংলাদেশ জলবায়ু উন্নয়ন অংশীদারিত্বের মতো উদ্যোগের উল্লেখ করে জলবায়ু পরিবর্তনের মধ্যে বাংলাদেশের স্থিতিস্থাপকতার প্রশংসা করেন। উদ্ভাবনী অর্থায়ন ও আন্তঃসীমান্ত সহযোগিতার আহ্বানসহ ন্যাপ বাস্তবায়নে আর্থিক সীমাবদ্ধতার মতো চ্যালেঞ্জগুলোকে স্বীকার করে তিনি বলেন, এর সাফল্যের জন্য সরকারি, বেসরকারি অংশীজন ও স্থানীয় সম্প্রদায়ের সম্পৃক্ততা অত্যাবশ্যক। কার্যকর অভিযোজন কৌশলগুলোর জন্য ডেটা, সক্রিয় পরিমাপ ও অন্তর্ভুক্তিকে হাইলাইট করা হয়েছে। তিনি জরুরিভিত্তিতে ন্যাপ বাস্তবায়নের জন্য সম্মিলিত পদক্ষেপের আহ্বান জানান, অংশগ্রহণকারীদের তাদের অবদানের জন্য ধন্যবাদ জানান এবং দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য উন্নত বিশ্বের প্রতি আহ্বান জানান।

চার দিনের এক্সপোতে দেশি-বিদেশি এক্সপার্ট ও কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে একাধিক সেমিনার, প্রশিক্ষণ ও আলোচনার পাশাপাশি এখানে সরকারের একাধিক মন্ত্রণালয় ও অধিদফতরের স্টল ছিল। এসব স্টলে বাংলাদেশের অভিযোজন কর্মকাণ্ড ও পরিকল্পনা তুলে ধরা হয়।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের স্টলে দেখা গেল দুর্যোগ মোকাবিলায় বাংলাদেশ সরকারের নানামুখী পদক্ষেপ তুলে ধরা হয়েছে মিনিয়েচার আর্টের মাধ্যমে। বন্যাপ্রবণ ও নদীভাঙন এলাকায় বন্যা আশ্রয়কেন্দ্র, সাইক্লোন সেন্টার, মুজিব কিল্লা, ভূমিকম্প ও অন্যান্য দুর্যোগে অনুসন্ধান, উদ্ধার অভিযান পরিচালনা এবং জরুরি যোগাযোগের জন্য যন্ত্রপাতি যেমন ক্রেন ও নৌযানের মিনিয়েচার কাঠামো, পরিবেশবান্ধব ও অধিক কার্যকর ইটের তৈরি (এইচবিডি) রাস্তার চিত্র ইত্যাদি তুলে ধরা হয়েছে।

স্টলে উপস্থিত অধিদফতরের প্রকৌশলী আজাদ বলেন, ‘মন্ত্রণালয়ের চলমা প্রকল্প ও কার্যক্রম বাস্তবসম্মতভাবে তুলে ধরা হয়েছে।’ মুজিব কিল্লা সম্পর্কে তিনি বলেন, নিচু ভূমিতে ভিটে উঁচু করে অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়, যেখানে এক অংশে মানুষ থাকে আর আরেক অংশে থাকে গবাদি পশু। সারাদেশে এমন ১২৫টির মতো মুজিব কিল্লা উদ্বোধন হয়েছে। আরও কয়েকটি নির্মাণাধীন রয়েছে।

স্টল থেকে জানা গেল দেশ বিদেশের অনেক দর্শনার্থীই আগ্রহ নিয়ে এসব ডেমো দেখেছেন। এক্সপোতে নজর কাড়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ের স্টল। উদ্বোধনের দিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে এই স্টলে এসে প্রায় তিন মিনিট অবস্থান করে ও বিদেশি অতিথিদের কাছে স্মার্ট কৃষির নানা দিক তুলে ধরেন। বিশেষ করে ফ্লোটিং বেডের বিষয়টি বর্ণনা করেন।

এই স্টলে স্মার্ট বাংলাদেশের স্মার্ট কৃষির নানা পদ্ধতির মিনিয়েচার ডেমো প্রদর্শন করা হয়। এ ছাড়াও ছিল ভাসমান বেডে সবজি উৎপাদনের প্রায়োগিক রূপ, যেখানে জীবন্ত চারা দেখানো হয়েছে। লবণাক্ত পানিতে চাষাবাদের পদ্ধতি, কৃষিতে সৌরশক্তির ব্যবহার ইত্যাদিও দেখানো হয়েছে মিনিয়েচার ফর্মে।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা তরিকুল ইসলাম বলেন, ২০৪১ সালের কৃষি কেমন হবে আমরা তাই তুলে ধরেছি। এখানে ডাগ ওয়েলের (পাতকুয়ার) ব্যবহার, সোলার প্যানেলের মাধ্যমে সৌর বিদ্যুতের ব্যবহারে সবিস্তারে তুলে ধরা হয়েছে। চাষাবাদ থেকে শুরু করে ফসল কাটা, সংগ্রহ ও বাজারজাতকরণের স্মার্ট পদ্ধতির সবটা এখানে উঠে এসেছে।

জলাবদ্ধ এলাকায় সার্জন পদ্ধতির ব্যবহার সম্পর্কে তরিকুল বলেন, এক থেকে দেড় ফুট জমিতে মাটি কিছুটা উঠিয়ে তাতে নানারকম সবজি চাষ করা হবে। উপকূলে লবণাক্ত পানিতে চাষযোগ্য ধান, তরমুজ, পাট, আলুসহ নানা সবজির নানা জাত ও পদ্ধতি তুলে ধরা হয়। এ ছাড়াও দেখানো হয়েছে ভাসমান ও মালচিং পদ্ধতির চাষাবাদ যা বণ্যাপ্রবণ, উপকূলীয় ও হাওরাঞ্চলে পানির মধ্যেই করা যাবে। মোট কথা, প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কীভাবে স্মার্ট কৃষির মাধ্যমে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারে, তা তুলে ধরা হয়।

স্টলের কর্মকর্তারা জানালেন, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তানসহ আফ্রিকার নানা দেশের অতিথিরা আগ্রহ নিয়ে এসব মিনিয়েচার ও মডেল দেখেছেন এবং নানা খুঁটিনাটি জানতে চেয়েছেন।

পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের স্টলে তুলে ধরা হয় জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়া বিভিন্ন প্রকল্পের বিস্তারিত। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আলী আহসান নিশাত বলেন, আমাদের সব প্রকল্পই জলবায়ু পরিবর্তনের কথা মাথায় রেখে নেওয়া হয়। দেশব্যাপী খাল খনন, ২০১২ সালে গৃহীত হাওর মহাপরিকল্পনা ইত্যাদি নানা প্রকল্পেরই বিস্তারিত তুলে ধরা হয়।

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার জন্য উন্নয়নশীল দেশগুলোকে সাহায্য দিতে ২০১৪ সালে ন্যাপ গ্লোবাল নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠিত হয়। এরই আওতায় ২০২২ সালে বাংলাদেশ সরকার ন্যাশনাল অ্যাডাপ্টেশন প্ল্যান (জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা) গ্রহণ করে। এর আওতায় ২০২৩-২০৫০ সালের জন্য বাংলাদেশের প্রয়োজন ৫৩৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর মধ্যে ৩৩৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বাংলাদেশ ব্যয় করে, বাকি টাকা প্রয়োজন উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে। ঢাকায় আয়োজিত চার দিনের ন্যাপ এক্সপোর মাধ্যমে সেটির যৌক্তিকতাই তুলে ধরা হয়েছে

সারাবাংলা/আরএফ/টিআর

Tags: , , , , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন