বিজ্ঞাপন

ঘূর্ণিঝড় রেমাল: জানমাল বাঁচাতে উপকূল ছাড়ছে মানুষ

May 26, 2024 | 12:58 pm

ইমরান চৌধুরী, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট

পতেঙ্গা (চট্টগ্রাম) থেকে: উত্তর-পশ্চিম বঙ্গোপসাগর ও সংলগ্ন এলাকায় সৃষ্ট রেমাল পরিণত হয়েছে প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে। সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাতের মধ্যে উপকূলে আঘাত হানতে পারে ঘূর্ণিঝড়টি। এরই মধ্যে পায়রা ও মোংলা সমুদ্রবন্দরে ১০ নম্বর মহাবিপৎসংকেতের পাশাপাশি চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার সমুদ্রবন্দরে ৯ নম্বর মহাবিপৎসংকেত জরি করা হয়েছে। রেমালের প্রভাবে চট্টগ্রামসহ উপকূলীয় জেলাগুলোতে ঝড়-বৃষ্টিও শুরু হয়েছে। এ অবস্থায় প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতের আশঙ্কায় জানমাল বাঁচাতে চট্টগ্রামের উপকূল ছাড়তে শুরু করেছেন বাসিন্দারা।

বিজ্ঞাপন

রোববার (২৬ মে) সকালে নগরীর পতেঙ্গার আকমল আলী রোডে বেড়িবাঁধসংলগ্ন জেলেপাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, ঘূর্ণিঝড় নিয়ে স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে। জেলেরা তাদের নৌকা ও মাছ ধরার জাল নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিতে ব্যস্ত। ঘরের নারী-শিশুরা আবার কাপড়চোপড়, হাড়ি-পাতিলসহ আসবাব নিয়ে অবস্থান নিয়েছেন বেড়িবাঁধে।

জেলেপাড়ার এক গৃহবধূ কান্তা রাণী জলদাসের সঙ্গে কথা হয় সারাবাংলার এই প্রতিবেদকের। তিনি বলেন, ‘সকাল থেকে আকাশে কখনো রোদ, আবার কখনো মেঘে ঢাকা থাকছে। বাতাসও হচ্ছে প্রচুর। সবাই বলছে, এবার ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষয়ক্ষতি বেশি হতে পারে। গত রাত (শনিবার রাত) থেকে মাইকিং করা হচ্ছে। আমরা কেউ বেড়িবাঁধের ওপর, কেউ আত্নীয়-স্বজনদের ঘরে আশ্রয় নিচ্ছি। তবে পুরুষরা সবাই এখানে থাকছে।’

আরও পড়ুন-

বিজ্ঞাপন

পঙ্কজ জলদাস নামে জেলেপাড়ার আরেক বাসিন্দা সারাবাংলাকে বলেন, ‘আকাশের অবস্থা ও পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে এবার ঘূর্ণিঝড়ের মাত্রা গতবারের মোখার চেয়েও খারাপ হবে। তাই জাল ও নৌকাগুলো নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিচ্ছি। ঘরের বউ ও ছেলেকে আমার বড় দাদার বাসায় রেখে এসেছি। আমি এখানে ঘরে থাকা জিনিসপত্রগুলো দেখাশোনা করার জন্য আছি।’

গৃহবধূ প্রাণপতি জলদাস সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের দুইটা নৌকা। তিন ছেলে ও স্বামী সেগুলো নিরাপদে রাখতে গেছে। যারা যাওয়ার তারা অনেকেই বেড়িবাঁধের ওপারে চলে গেছে। আমরাও জিনিসপত্র নিরাপদ স্থানে রেখে এসেছি। আমার স্বামী ও ছেলেরা এলে আমিও চলে যাব।’

বিজ্ঞাপন

কোথায় যাবেন— জানতে চাইলে এ গৃহবধূ বলেন, ‘আশপাশে তেমন ভালো কিছু (সাইক্লোন শেল্টার) নেই। যেটা আছে, অনেক দূরে। জিনিসপত্র নিয়ে অত দূরে যাওয়া সম্ভব না। বেড়িবাঁধের ওপারে আমার দূরসম্পর্কের এক বোনের বাসা আছে। সেখানেই যাব।’

রেমালের প্রভাবে উত্তাল পতেঙ্গা। ছবি: শ্যামল নন্দী/ সারাবাংলা

এদিকে পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত, পারকি সৈকতসহ বিভিন্ন দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় মানুষদের সরে যেতে মাইকিং করতে দেখা গেল রেড ক্রিসেন্টের স্বেচ্ছাসেবকদের।

রেড ক্রিসেন্ট জোনাল কো-অর্ডিনেটর তৌসিফ রেজওয়ান সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা গতকাল (শনিবার) রাত থেকে দুই শিফটে ভাগ হয়ে কাজ করছি এখানে। এক শিফটে ১০ জন করে আছে। মাইকিং করে আমরা মানুষকে নিরাপদ স্থানে সরে যেতে অনুরোধ করছি। নারীরা অনেকেই তাদের ছোট বাচ্চাদের নিয়ে চলে গেছেন। আশপাশে ভালো সাইক্লোন শেল্টার না থাকায় তারা আত্মীয়-স্বজনদের বাসায় উঠেছেন বলে শুনেছি।’

রোববার সকাল সাড়ে ১১টার দিকে বেড়িবাঁধসংলগ্ন জেলেপাড়ায় যান বন্দর-পতেঙ্গা আসনের সংসদ সদস্য এম এ লতিফ। এ সময় তিনি স্থানীয় বাসিন্দাদের যত দ্রুতসম্ভব এলাকা ত্যাগ করার আহ্বান জানান। বাসিন্দারা তাকে আশ্বস্ত করেন, সন্ধ্যার মধ্যেই সবকিছু নিয়ে তারা নিরাপদ স্থানে সরে যাবেন।

বিজ্ঞাপন

জেলেপাড়ার সবাই নিরাপদ আশ্রয়ের দিকে ছুটছেন। ছবি: শ্যামল নন্দী/ সারাবাংলা

এম এ লতিফ সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি এ এলাকার সংসদ সদস্য। তারাই আমাকে ভোট দিয়ে সংসদ সদস্য করেছেন। তাদের সুখে-দুঃখে থাকা আমার জন্য ফরজ। আমি বিকেলে আবার আসব। তাদের আপাতত বলেছি নিরাপদ স্থানে যত দ্রুতসম্ভব সরে যেতে। তারা আমাকে কথা দিয়েছে, সরে যাবে। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে তাদের ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হলে আমি আবার সেগুলো করে দেবো।’

অন্যদিকে ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাব মোকাবিলার প্রস্তুতি নিয়েছে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন ও সিটি করপোরেশন। জানমালের ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে নগরীর সাগর তীরবর্তী এলাকা এবং ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ের বাসিন্দাদের আশ্রয়কেন্দ্র ও নিরাপদ স্থানে চলে যেতে মাইকিং করছে সিটি করপোরেশনের টিমও। সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে নগরীর দামপাড়ায় বিদ্যুৎ বিভাগের কার্যালয়ে একটি নিয়ন্ত্রণ কক্ষ চালু করা হয়েছে। যেকোনো প্রয়োজনে নিয়ন্ত্রণ কক্ষের ০১৮১৮৯০৬০৩৮ নম্বরে যোগাযোগের জন্য বলা হয়েছে।

চট্টগ্রামের উপকূলীয় সন্দীপ, আনোয়ারা, বাঁশখালী, মীরসরাই, সীতাকুণ্ড ও কর্ণফুলী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের বিশেষ প্রস্তুতি নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন জেলা প্রশাসক। তাদের পর্যাপ্ত পরিমাণ শুকনো খাবার, মোমবাতি, ওষুধ, পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট ও খাবার স্যালাইন মজুত রাখতে বলা হয়েছে।

অনেকেই জানালেন, আশপাশে ভালো সাইক্লোন শেল্টার না থাকায় তারা আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িতে আশ্রয় নিচ্ছেন। ছবি: শ্যামল নন্দী/ সারাবাংলা

চট্টগ্রামে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের ৭৮৫টি আশ্রয়কেন্দ্র ছাড়াও এক হাজার ১৪০টি বিদ্যালয় ও ৯টি মুজিব কেল্লা আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এ ছাড়া সিভিল সার্জন ইউনিয়ন পর্যায়ে ২০০টি, প্রতিটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পাঁচটি, ৯টি আরবান ডিসপেনসারিতে ৯টি ও পাঁচটি জেনারেল হাসপাতালে পাঁচটিসহ মোট ২৯৫টি মেডিকেল টিম গঠন করেছে।

জেলা প্রশাসনের কাছে পানি বিশুদ্ধকরণের জন্য প্রায় তিন লাখ ট্যাবলেট ও চার লাখ খাবার স্যালাইন মজুত আছে। ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচি সিপিপির আওতায় আট হাজার ৮৮০ জন এবং রেড ক্রিসেন্টের পাঁচ হাজার স্বেচ্ছাসেবককে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় প্রস্তুত রাখা হয়েছে।

ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলার কার্যক্রম সমন্বয়ের জন্য জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে একটি নিয়ন্ত্রণ কক্ষ খোলা হয়েছে, যার নম্বর ০২৩৩৩৩৫৭৫৪৫।

চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) রাকিব হাসান সারাবাংলাকে বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে চট্টগ্রামে ব্যাপক বর্ষণ ও পূর্ণিমার কারণে তীব্র জলোচ্ছ্বাসের আশঙ্কা আছে। আবহাওয়া অধিদফতর পাহাড়ধসের আশঙ্কাও করছে। এ অবস্থায় উপকূলবর্তী এলাকা ও পাহাড়ি এলাকা থেকে লোকজনকে দ্রুত সময়ের মধ্যে সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা চলছে।’

মালামাল যা কিছু আছে, আগে সেগুলোকে নিরাপদ আশ্রয়ে নিতে ব্যস্ত জেলেপাড়ার ছেলেবুড়ো সবাই। ছবি: শ্যামল নন্দী/ সারাবাংলা

চট্টগ্রাম কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর ও মৎস্য বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, চট্টগ্রামে এরই মধ্যে প্রায় ৯০ শতাংশ ফসল কাটা শেষ হয়েছে। মাছ ধরার সব নৌকা তীরে এসে গেছে। গবাদি পশুকে নিরাপদে রাখার জন্য জেলা প্রশাসক নির্দেশনা দিয়েছেন। এ ছাড়া কোনো জেলে যেন দুর্যোগের মধ্যে মাছ ধরার জন্য নদীতে যেতে না পারে, তা নজরদারি করার জন্য ইউএনওসহ সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

আবহাওয়া অধিদফতরের সর্বশেষ বিশেষ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ঘূর্ণিঝড় রেমাল রোববার সকাল ৯টায় চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে ৩৮০ কিলোমিটার দক্ষিণপশ্চিমে, কক্সবাজার সমুদ্রবন্দর থেকে ৩৪০ কিলোমিটার দক্ষিণপশ্চিমে, মোংলা সমুদ্রবন্দর থেকে ২৯৫ কিলোমিটার দক্ষিণে এবং পায়রা সমুদ্রবন্দর থেকে ২৬৫ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থান করছিল। এটি আরও উত্তর দিকে অগ্রসর হয়ে উপকূল অতিক্রম করতে পারে।

রেমালের সম্ভাব্য গতিপথ ও আঘাত হানার সময় নিয়ে বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ঘূর্ণিঝড়টি রোববার সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত সময়ের মধ্যে মোংলার কাছ দিয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সাগর দ্বীপ ও বাংলাদেশের খেপুপাড়ার উপকূল অতিক্রম করতে পারে। বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের অগ্রভাগের প্রভাবে দমকা হাওয়াসহ বৃষ্টি শুরু হয়েছে।

আরও পড়ুন-

সারাবাংলা/আইসি/আরডি/টিআর

Tags: , , , , , , , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন