বিজ্ঞাপন

ছাত্রনেতারা গান শিখুক! বই পড়ুক!

September 18, 2019 | 4:36 pm

ফেরদৌস আহমেদ উজ্জল

বেশ কয়েকদিন ধরেই জমকালো মিডিয়া কাভারেজে আমরা দেখছি ছাত্রলীগের প্রধান দুই নেতার চাঁদাবাজির খবর এবং তাদের সরিয়ে দেওয়া। যাই হোক, নিশ্চয়ই দুয়েকদিনের মধ্যেই সেই খবরে কিছুটা ভাটা পড়বে। আর চলে যাবো নতুন কোনো আলোচনায়। তার আগে আমি এখানে সামান্য কিছু কথা বলতে চাই।

বিজ্ঞাপন

ছাত্র রাজনীতির প্রধান সংকট এখন আর চাঁদাবাজিতে সীমাবদ্ধ নেই। সংকটটা হলো- নেতারা ছাত্র রাজনীতি ও আন্দোলনের প্রকৃত রূপ পাল্টে দিয়েছেন। সেজন্যই দেশব্যাপী এর আপাদমস্তক সব পাল্টে গেছে। একটা গল্প দিয়েই শুরু করি- ছেলে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। মাঝে মধ্যে মিছিল মিটিংয়ে যায়। ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের সাথে তার ওঠাবসা। হঠাৎ করেই সে বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতা হয়ে যায়। তার পরিবার, আত্মীয়-পরিজন ও এলাকাবাসীর মধ্যে ব্যাপক শোরগোল। ছেলে বিশাল নেতা বনে গেছে। এরপর তার কাছে আসতে থাকে বিভিন্ন অনুরোধ- আমার ছেলেটাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করানো যায় কিনা, একটু হলে রাখার ব্যবস্থা করা যায় কিনা, একটি চাকরির ব্যবস্থা করা যায় কিনা ইত্যাদি।

এই চিত্রটা খুবই পরিচিত। অন্তত যারা বিশ্ববিদ্যালয় বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন তারাতো জানেন-ই। এটা আমাদের সামজের মানুষদের একটা বড় অংশের অভিব্যক্তি। আমার গ্রামের একজন বলতেন বাঙালি জেতার পক্ষে জয়ধ্বনি করে। এমনকি আমাদের মত ছোট সংগঠনের নেতাদের কাছেও কখনও কখনও ফোন আসতো- ছেলেকে অমুক জায়গায় ভর্তি করানো যায় কিনা, হলে একটা সিট করে দাও ইত্যাদি।

এখন ছাত্র নেতাদের বাস্তবিক অবস্থাটা কী? নেতা হতে প্রথমেই ধরনা দিতে হয় পার্টির পাতি, মাঝারি ও বড় নেতাদের কাছে। সেই নেতাদের সন্তুষ্ট করতে তাদের বাড়ির বাজার করা, ফুটফরমায়েশ খাটা থেকে শুরু করে হেন কোনো কাজ নেই যে করতে হয় না। পাশাপাশি তাদের অবৈধ কাজের পাহারাদার ও লাঠিয়াল হিসেবেতো থাকতেই হয়। মাদক কী অস্ত্র হোক, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি এগুলো কি ছাত্রনেতারা নিজ থেকেই করে? নাকি তাদের দিয়ে করানো হয়? কারা করায়, কেন করায়, তা খতিয়ে দেখা জরুরি।

বিজ্ঞাপন

ক্ষমতাসীনদের মধ্যে সিন্ডিকেট কথাটা বেশ জনপ্রিয়। এই কথার শানে নুযুলটা তারাই ভালো বলতে পারবেন। আমি একটি সংগঠনের কেন্দ্রীয় পদে দায়িত্ব পালন করেছি দীর্ঘসময়। তখন দেখেছি ছাত্রদল ও ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের প্রতিটি উৎসবে নেতাকর্মীদের সালামি দিতে। তাদের মুখেই শুনেছি এটা না করলে তারা টিকতেই পারবে না। তারাও নাকি একইভাবে সালামি পায় বড় নেতাদের কাছ থেকে। তার মানে সালামি একটি চক্রাকার ব্যবস্থা। যে ব্যবস্থায় রাজনীতির অনেকেই যুক্ত।

এখন আসি ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রনেতা হলেই গাড়ি-বাড়ি কোথা থেকে আসে সে কথায়। আমাদের সময় দেখেছি, ক্ষমতাসীন দলের একজন কর্মী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নেতার মোটরসাইকেল চালাতো। হঠাৎ করেই সে কেন্দ্রীয় নেতা বনে গেল। রাতারাতি তার গাড়ি আর বিলাসবহুল ফ্ল্যাট। এখন প্রশ্ন হলো- এগুলো এত দ্রুত কীভাবে আসে? কারা দেয়? কেন দেয়? আমি কারও কারও কাছ থেকে জেনেছি যে, দলের মধ্য থেকে ব্যবসায়ী নেতাদের কেউ কেউ তাদের হাতে রাখার জন্য এই গাড়ি, বাড়ি ও বিলাসবহুল জীবনের ব্যবস্থা করে দেয়। কারণ, এদের দিয়ে ব্যবসায়ী নেতারা বড় ধরনের কাজ বাগিয়ে নিতে চান।

বিশ্ববিদ্যালয় হোক অথবা যেকোনো উন্নয়ন কার্যক্রমই হোক, সেখানে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের নেতারাই দৌরাত্ম দেখায়, এটাই স্বাভাবিক। এটাই সারাদেশের মানুষ দেখছে প্রতিদিন। তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত কোন পার্থক্য নেই। এটা রহিমউদ্দিনও জানে, কালিদাশও জানে। আর এই শোভন-রাব্বানীর ঘটনাই প্রথম নয়। এটা দেখে তাজ্জব বনে যাবার দরকার নেই। যদি অনুসন্ধান করা যায় তবে দেখা যাবে, সব জায়গার চিত্র একই রকম।

বিজ্ঞাপন

সংকট আসলে কোথায়? এটা কিন্তু চাঁদাবাজিতে সীমাবদ্ধ নেই। সংকটটা হলো- নেতারা ছাত্র রাজনীতি ও আন্দোলনের প্রকৃত রূপই পাল্টে দিয়েছেন। একসময় ছাত্রদের অধিকার, শিক্ষানীতি আন্দোলন, স্বাধিকারের প্রশ্নে, গণতন্ত্রের লড়াইয়ে যে ছাত্র সংগঠনগুলো প্রাণপণ লড়াই করেছে, তাদেরই কেউ কেউ আজ নষ্ট স্রোতে গা ভাসাচ্ছেন। যদিও এই চর্চা নতুন নয়। দীর্ঘদিন ধরেই ক্ষমতাসীন সংগঠনগুলো এই ক্ষমতাবাজিতেই লিপ্ত রয়েছে। তারা প্রকৃত ছাত্রদের অধিকার নিয়ে লড়াইয়ের ময়দানে আর নেই। তারা যুক্ত ক্ষমতাকেন্দ্রিক ভাগ-বাটোয়ারায়। তাদের প্রটোকল লাগে- লাগে অর্থ, অস্ত্র আর বিলাশবহুল জীবন। তারাও এগুলো শেখে তাদের সিনিয়র নেতাদের কাছ থেকে। তাই আমি তাদের দোষ দেই না। সংকটটা তাই রাজনীতির- ক্ষমতাসীনদের ভোগবাদী, স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাবের। যেখানে কোন সৃজনশীলন ও নান্দনিকতার জায়গা নেই। ছাত্রনেতাদের গান না জানলেও চলবে। কিন্তু চোখ রাঙ্গানি জানতে হবে। বই না পড়লেও চলবে, শুধু বুলি আওড়ালেই চলবে।

যাহোক আমি একটা নিয়মতান্ত্রিক ছাত্রসংগঠন করতাম। সেটা ছাত্র ইউনিয়ন। সংগঠন করতে গিয়ে আমাদের ন্যূনতম কিছু পড়াশোনা করতে হতো। ইতিহাস, অর্থনীতি, সমাজটাকে বুঝতে হতো। আমরা সবাই জ্ঞানের ভাণ্ডার এমন ভাবার কারণ নেই। কিন্তু আমাদের প্রতিটা কাজের জন্য সংগঠনের নিয়নকানুন মেনে চলতে হতো। যেকোনো কাজের জন্যই নেতাকর্মীদের কাছে জবাবদিহি করতে হতো। আমরা সংগঠন চালাতাম গণচাঁদা আর ডোনারদের দেওয়া চাঁদা থেকে। ১০ টাকা তুললে তা কুপনে লিখে তুলতে হতো। প্রতিটি সম্পাদকমণ্ডলী, কেন্দ্রীয় ও জাতীয় পরিষদ সভায় অর্থের যাবতীয় হিসাব পাশ করতে হতো। সংগঠনের যেকোনো পর্যায়ের নেতার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ উঠলে সেটা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে দেখা হতো এবং ব্যবস্থা গ্রহণ করা হতো।

আমি শুধু ছাত্র ইউনিয়নের ক্ষেত্রেই বলব না; প্রগতিশীল অনেক সংগঠনের মধ্যেই নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন, সংগ্রাম ও সংগঠনের চর্চা রয়েছে। একটা ছাত্র সংগঠনের প্রধান খাদ্য হলো ছাত্র আন্দোলন, ছাত্রদের অধিকার নিয়ে কথা বলা। অথচ আমরা দেখি ক্ষমতাসীন সংগঠনগুলো ছাত্রদের সব সময়ই নিজেদের সেবক বানিয়েছে। হলে থাকতে হলে মিছিল করতে হবে, নেতাদের উঠতে-বসতে সালাম ঠুকতে হবে, যেকোনো অপকর্মে তাদের সঙ্গ দিতে হবে। অথচ ছাত্রদের স্বার্থরক্ষার কোনো আন্দোলনে তাদের খুঁজে পাওয়া যাবে না। কিন্তু আন্দোলন দমনে তারা ওস্তাদ।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ তাঁর এই উদ্যোগের জন্য। তবে নেতা পাল্টিয়ে কোনো লাভ নেই। এদের এই খাইখাই নীতি পাল্টিয়ে ছাত্রদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে নামতে বলেন দয়া করে। ছাত্রনেতাদের গান গাওয়া শিখতে বলেন। কবিতা পড়তে বলেন। আর না হলে এই সংগঠন হবে পলায়নপর। যেমনটা বঙ্গবন্ধু হত্যার পর হয়েছিল। সবশেষে দেশব্যাপী ছাত্র আন্দোলনের আদর্শিক ধারায় যারা লড়াই সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে তাদের প্রতি শ্রদ্ধা ও সংগ্রামী সালাম।

বিজ্ঞাপন

লেখক: সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন।

সারাবাংলা/পিটিএম

Tags: , , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন