বিজ্ঞাপন

নতুন এক রবার্ট ব্রুস ও ‘ফিনিক্স’ হয়ে ফিরে আসা তার ‘সৈন্য দল’

June 28, 2020 | 10:00 am

সাহাবার সাগর, নিউজরুম এডিটর

অপেক্ষা ৩০ বছরের! সুনির্দিষ্টভাবে ৩০ বছর ২ মাস ৪ দিন। দিনের হিসাবে ভেঙে বললে ১১ হাজার দিনেরও বেশি! ২১ এপ্রিল ১৯৯০ থেকে শুরু। এরপর কেবলই যেন অপেক্ষার আগুনে পুড়ে পুড়ে ছাই হওয়া। তবে পুরান থেকে আমরা যে ফিনিক্স পাখির গল্প জানি, নিজের ছাই থেকেই সেই পাখি বারে বারে পুনর্জন্মের ইতিহাস গড়ে । ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে ঠিক তেমনই ৩০ বছরের অপেক্ষার আগুনে পুড়ে যে ছাই জমেছিল, সেই ছাই থেকেই যেন পুনর্জন্মের ইতিহাস রচনা করল লিভারপুল। আর সেই পুনর্জন্মের কাণ্ডারি যিনি, তিনি জার্মান লৌহমানব ইয়্যুর্গেন ক্লপ।

বিজ্ঞাপন

শিরোপার ফুল হয়ে ফোটার আগে সম্ভাবনার কুঁড়ির দেখা মিলছিল গত কয়েক বছর ধরেই। শেষ পর্যন্ত এবার তার সফল অনুবাদ হলো শিরোপার হাত ধরে। এর মধ্যে অবশ্য মজার একটি বিষয় আছে৩০ বছর পর শিরোপা পুনরুদ্ধারের কথা বলা হলেও ‘প্রিমিয়ার লিগে’র শিরোপা কিন্তু অল রেডদের এই প্রথম! কিভাবে সেটা?

এবারের আক্ষেপ ঘুচানোর শিরোপা জয়ের আগে ১৯৮৯/১৯৯০ মৌসুমে শেষবার ইংলিশ লিগ উঁচিয়ে ধরেছিল অল রেডরা। তখন প্রিমিয়ার লিগ নামটাই যে ছিল না। লিগের নাম তখন ছিল ফার্স্ট ডিভিশন। লিভারপুলের শিরোপা জেতার পর আরও দুই মৌসুম ওই একই নামে ছিল লিগ। ১৯৯২/১৯৯৩ মৌসুমে নাম পাল্টে রাখা হয় প্রিমিয়ার লিগ। তার মানে, ইংলিশ লিগের ইতিহাসের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সফল দলটির ঝুলিতে প্রকৃতপক্ষে ‘প্রিমিয়ার লিগে’র শিরোপাই ছিল না! ক্লপের হাত ধরে সেই হলো সেই অপেক্ষার সমাপ্তি।

কেনি ডাল্গলিশের হাত ধরে ১৯৮৯/১৯৯০ মৌসুমে শেষবার শিরোপা জয়ের পর অলরেডরা গুনে গুনে আরও ৯ জন কোচকে দলে ডেকেছেন। চূড়ান্ত সাফল্য দিতে না পারায় তাদের কেউ দলে দীর্ঘ মেয়াদে স্থায়ী হতে পারেননি, বিদায় নিতে হয়েছে স্বাভাবিকভাবেই। তবে এই ৯ জনের মধ্যে শিরোপার খুব কাছাকাছি গিয়েছিলেন জেরার্ড হুলিয়ের, রাফা বেনিতেজ আর ব্রেন্ডন রজার্স। ২০০১/২০০২ মৌসুমে জেরার্ড হুলিয়ের, ২০০৮/২০০৯ মৌসুমে রাফা বেনিতেজ আর ২০১৩/২০১৪ মৌসুমে ব্রেন্ডন রজার্সের তত্ত্বাবধানে লিগ রানার-আপের তকমা জোটে লিভারপুলের কপালে।

বিজ্ঞাপন

ইয়্যুর্গেন ক্লপ নিজেও অবশ্য রয়েছেন এই তালিকায়। ঠিক আগের মৌসুমে, অর্থাৎ ২০১৮/২০১৯ মৌসুমে একই অর্জন ছিল ইয়্যুর্গেন ক্লপেরও। সেবার শিরোপার দেখা না মিললেও এক মৌসুমে নিজেদের সর্বোচ্চ পয়েন্টের রেকর্ডও গড়েছিল লিভারপুল। মৌসুম শেষ করেছিল ৯৭ পয়েন্ট নিয়ে। তারপরও বিধি বাম হলে যা হয়! পেপ গার্দিওলার ম্যানচেস্টার সিটি সেবার আরও এক পয়েন্ট বেশি পেয়ে শিরোপা ছিনিয়ে নেয়। এর আগের মৌসুমে অবশ্য ১০০ পয়েন্টের রেকর্ডও আছে ম্যান সিটির। তবে চলতি মৌসুমে সে রেকর্ডও নিজেদের করে নেওয়ার পুরো সুযোগই রয়েছে অল রেডদের সামনে। ৩১ ম্যাচে ৮৬ পয়েন্ট পাওয়া দলের কাছে ৭ ম্যাচে ১৫ পয়েন্ট আর এমন বেশি কী!

গত মৌসুমে যেখানে শেষ করেছিল লিভারপুল, এবার যেন শুরুটা হয়েছে ঠিক সেখান থেকেই। এবারের গতি ছিল বরং আরও দুর্বার। আর তাই তো লিগ শেষ হওয়ার ৭ ম্যাচ বাকি থাকতেই পয়েন্ট টেবিলের দ্বিতীয় স্থানে থাকা ম্যান সিটির চেয়ে ২৩ পয়েন্ট এগিয়ে লিভারপুল। অর্থাৎ ৭ ম্যাচ হাতে রেখেই এবার নিশ্চিত হয়েছে শিরোপা। এত বেশি ম্যাচ হাতে রেখে শিরোপা জয়ের ইতিহাস ইংলিশ লিগে আর নেই।

বিজ্ঞাপন

লিভারপুলের এই যে পুনর্জাগরণ, এর পেছনে মূল অবদান কিন্তু সেই ইয়্যুর্গেন ক্লপের। ২০১৫ সালে বরুশিয়া ডর্টমুন্ড ছেড়ে দায়িত্ব নিয়েছিলেন অল রেডদের। একসময়কার শীর্ষ দলটি তখন ঠিক শীর্ষ দলের তালিকায় থাকতে পারছিল না। তারা তখন ছিল লিগের ‘মিড’ টেবিলে, অর্থাৎ দ্বিতীয় সারির দল বলা যায়। চ্যাম্পিয়নস লিগ খেলা নিয়েই যে তখন টানাটানি!

ক্লপের দায়িত্ব নেওয়ার আগের মৌসুমে যেখানে ষষ্ঠ স্থানে থেকে লিগ শেষ করেছিল লিভারপুল। ক্লপ এসে দায়িত্ব বুঝে নিতে নিতে অবস্থা আরও সঙ্গীন, সেবার পয়েন্ট টেবিলের অষ্টম স্থানে থেকে কোনোমতে ইউরোপা খেলার সুযোগ ধরে রাখতে পারে লিভারপুল। একটা বছরে দলকে বুঝে নিয়েই ক্লপকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। মোহাম্মদ সালাহদের পরের দুই মৌসুমেই চ্যাম্পিয়নস লিগ নিশ্চিত হয় ঠিক ঠিক চতুর্থ স্থানে থেকে। এর মধ্যে ২০১৭/২০১৮ মৌসুমে চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালেও উঠেছিল লিভারপুল। কিন্তু ফাইনাল খেলার অভিজ্ঞতা ভুলে যাওয়া দলটি বোধ হয় সেই অনভিজ্ঞতাতেই শিরোপার স্বাদ পায়নি। চেয়ে চেয়ে রিয়াল মাদ্রিদের হাতে দেখতে হয়েছিল শিরোপা।

পরের মৌসুমে আরও উত্তরণ। লিগ টেবিলের কথা তো বলাই হয়েছে, শিরোপা না জিতলেও নিজেদের সর্বোচ্চ পয়েন্ট ঝুলিতে পুড়ে নিতে পেরেছিল দলটি। আর টানা দ্বিতীয়বারের মতো ফাইনালে উঠে আর আক্ষেপে পুড়তে হয়নি। টটেনহ্যাম হটস্পারকে হারিয়ে দিতে ঘরে তোলে নিজেদের ষষ্ঠ উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগের শিরোপা। ২০০৫ সালের পর ইউরোপ সেরার তকমা লিভারপুলের জন্য ছিল এই প্রথম।

১৪ বছরের আক্ষেপ ঘুচিয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতলেও ৩০ বছরের আক্ষেপটা আর বাড়তে দিতে চাননি ক্লপ এবং তার বাহিনী। ২০১৯/২০২০ মৌসুমে প্রিমিয়ার লিগের ৩১টি ম্যাচ খেলে (মোট ৩৮টি ম্যাচ) মাত্র এক ম্যাচে হার, ড্র মাত্র ২টিতে আর বাকি ২৮ ম্যাচে জয়। দুর্দান্ত মৌসুমের ৭ ম্যাচ বাকি থাকতেই শিরোপা ঘরে। অপেক্ষা ঘুচল ৩০ বছরের।

বিজ্ঞাপন

এর আগের ইতিহাসটা, ফাইনালে গোল করে এগিয়ে যাওয়ার পরেও মরেনোর পাগলামিতে একটুর জন্যে ইউরোপা হাতছাড়া হয়েছিলো ২০১৬। ক্লপের তখন লিভারপুলের হয়ে দায়িত্ব গ্রহণের প্রথম মৌসুম। ইউরোপা লিগের ফাইনাল হারের পর ক্লপ সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘If we sit here in four years I think we’ll have won one title. I’m pretty sure’.

লিভারপুলের লক্ষ্য তখন স্থির, ক্লপকে ঘিরে সাজানো হবে দল, সময় দেওয়া হবে যতটা সম্ভব। এরপর এক বছর সময় নিলেন দল গোছাতে। পরের মৌসুমে লিগ কাপের ফাইনাল ম্যানচেস্টার সিটির কাছে টাই ব্রেকারের পেনাল্টি শ্যুট আউটে হার। হারের বৃত্তটা পরের বছর গড়াল চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে রিয়াল মাদ্রিদের কাছে হার পর্যন্ত। আর ওই ফাইনালে দিয়ে সাবেক ক্লাব বরুশিয়া ডর্টমুন্ড এবং লিভারপুলের হয়ে টানা ছয়টা ফাইনাল হারলেন ক্লপও! চ্যাম্পিয়ন্স লিগ হারের পরদিন সকালে ক্লপের একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়ল ইন্টারনেট জগতে, সেখানে দেখা মিলল ক্লপ লিভারপুল সমর্থকদের নিয়ে ‘We saw the European Cup, Madrid had all the f****** luck, we’ll just keep on being cool, and bring it back to Liverpool! গান গাইচ্ছেন!

তাতে অবশ্য লিভারপুলের অন্য সমর্থকরা ক্ষুদ্ধ না হয়ে আরও বেশি সমর্থন দিতে থাকলেন ক্লপকেই। তাদের আস্থা ছিল, ক্লপ পারবেন। ষষ্ঠ ফাইনাল হেরে ক্লপ যেন তখন শিরোপা জিততে মরিয়া। রবার্ট ব্রুস যেমন সপ্তম বারের চেষ্টায় জয় পেয়েছিলেন যুদ্ধের ময়দানে, ক্লপ তেমনি সপ্তম ফাইনালে গিয়ে দেখা পেলেন কাঙ্ক্ষিত সেই জয়ের, লিভারপুলও পেল চ্যাম্পিয়নস লিগের শিরোপা। স্টিভেন জেরার্ড-জাবি আলোন্সোরা এসি মিলানের বিপক্ষে ২০০৫ সালের চ্যাম্পিয়ন্স লিগে যে রূপকথা গড়েছিলেন, তার ১৪ বছর পর আবারও ইউরোপের শ্রেষ্ঠত্ব পুনরুদ্ধার। শিরোপা উঠলো জর্ডান হেন্ডারসনের হাতে।

তবে ইউরোপের শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট পরা হলেও ১১শ ২৩ দিনের আক্ষেপটা সেবার মেটেনি। ৯৭ পয়েন্ট নিয়েও রানার আপ। মৌসুম শেষে ক্লপ সেবার বলেছিলেন, ‘We’ll go again’.

ক্লপ তার কথা রেখেছেন, তারা পরেরবার আবারও করেছেন। তবে এবার আর দ্বিতীয় হয়ে আক্ষেপ করার জন্য নয়। এবার তারা জিতেছেন শ্রেষ্ঠত্ব। তারা ছিনিয়ে নিয়েছে নিজেদের প্রাপ্য। লিভারপুল নিজেদের ২০তম লিগ শিরোপা জয় করেছে। আর প্রিমিয়ার লিগ সময়ের প্রথম। আর সেই ইতিহাসের রচয়িতা ইয়্যুর্গেন ক্লপ।

শিরোপা জয়ের পর অলরেডদের অধিনায়ক জর্ডান হেন্ডারসন বলেছেন, ‘To be honest I’m lost for words. You never really think of this moment. When this moment comes I can’t really describe it’.

লিভারপুলের ডাচ ডিফেন্ডার ভার্জিল ভ্যান ডাইক লিখেছেন, ‘At the end of a storm, there’s a golden sky.. We did it! Dreams do come true..’

মিশরীয় তারকা মোহাম্মদ সালাহ লেখেন, ‘Yes. It feels THAT good. I want to thank all our supporters watching us from all corners of the world. You made this possible for us and I hope we can keep bringing you the joy you deserve. Now they’re gonna believe us.’

এ যেন ৩০ বছরের ক্ষুধা মেটানো শব্দগুলো ঝরে পড়েছে অল রেডদের খেলোয়াড়দের মুখ থেকে। অপেক্ষার ফল যে মধুর হয়, সেটাই যেন প্রমাণ করলেন ইয়্যুর্গেন ক্লপ এবং তার বাহিনী।

চলতি মৌসুমসহ মোট পাঁচ মৌসুম লিভারপুলের ডাগ আউটে ক্লপ। এর মধ্যেই জিতেছেন একটি করে, ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ, উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগ, উয়েফা সুপার কাপ এবং ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপও। ক্লপ নিশ্চয় চাইবেন, এই জয়রথকে আরও এগিয়ে নিতে। ৩০ বছরের শিরোপা খরা থাকলেও লিভারপুল ইংলিশ লিগের দ্বিতীয় সফলতম দল। গত কয়েক মৌসুমের পারফরম্যান্স ধরে রেখে আগামী মৌসুমেও শিরোপা ধরে রাখার প্রত্যয়ই নিশ্চয় কাজ করছে ক্লপের মগজেও। সেটা পারলে কিন্তু ইংলিশ লিগের সর্বোচ্চ সাফল্যে আরেক কিংবদন্তী দল ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডকে ছুঁয়েই ফেলবে অল রেডরা। ক্লপের হাতে ‘ফিনিক্স’ হয়ে পুনর্জন্ম পাওয়া লিভারপুল সে চেষ্টায় ঘাটতি রাখবে না নিশ্চয়।

সারাবাংলা/এসএস/টিআর

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন