বিজ্ঞাপন

গণপরিবহন নৈরাজ্য ঠেকাতে গলদটা কোথায়?

August 19, 2020 | 1:02 pm

হাবীব ইমন

বিজ্ঞাপন

এক.
সম্প্রতি পারিবারিক একটি কাজে ঢাকা থেকে নোয়াখালীতে যেতে হয়েছিল। সেদিনের অভিজ্ঞতা শেয়ার করছি সবার সাথে- কিছুটা দুরু দুরু বুকে সেদিনের যাত্রা শেষ হয়। এক বন্ধুর কাছে খোঁজ নিয়ে লাল সবুজ নামের একটি বাসে উঠলাম। বাসটিতে যাত্রী ছিলেন মাত্র হাতে গোনা দশজন। সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী নিয়মিত ভাড়ার চেয়ে ৬০ শতাংশ বেশি নিলো। এ নির্দেশনা মানতে তাদের কোনো সমস্যা হয়নি। অথচ দেখা গেলো, বাসে সরকারি যে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কথা, সেগুলোর কোনোটাই তারা মানছেন না। বাসের চালক থেকে শুরু করে সুপারভাইজার, হেলপার; কারো মুখেই মাস্ক ছিল না। এমনকি স্যানিটাইজারের কোনো ব্যবস্থাও চোখে পড়েনি। নিজ দায়িত্বে আমাকে বসার জায়গা, আমার ব্যাগ স্যানিটাইজ করতে হয়েছে।

অন্যদিকে যাত্রার শুরুতে এবং শেষে বাধ্যতামূলকভাবে গাড়ির ভেতরসহ পুরো গাড়িতে জীবাণুনাশক স্প্রে করার কথা। কোথাও তা চোখে পড়েনি। কাউন্টারে বাস আসার সাথে সাথেই নতুন যাত্রী তুলে আবার গাড়ি চালাতে শুরু করলেন চালক। গন্তব্যে পৌঁছে নেমে যাওয়া যাত্রীর বসা সিটও পরিষ্কার করতে দেখিনি তাদের। এক সিট পরপর যাত্রী বসানো হলেও ওঠা-নামার সময় শারীরিক দূরত্ব নিশ্চিত হচ্ছে না। এমনকি বাসস্ট্যান্ড বা নির্ধারিত কাউন্টার ছাড়াও যেখানে-সেখানে যাত্রী ওঠানামা করতে দেখা গেছে। আরো বিস্ময়কর বিষয় হলো, দশজন যাত্রীর অধিকাংশের মুখেই কোনো মাস্ক ছিল না। তাদের মধ্যে ২-৪ জন শিশুও ছিল। আমি দুটো মাস্ক আর গ্লাভস ব্যবহার করেও সেই অবস্থায় ভীষণ আতঙ্কে ছিলাম।

এমনটাই ছিল সেদিনের অভিজ্ঞতা। এবার পরের দিনের অভিজ্ঞতাটা শেয়ার করি- সেদিন ভোরে একই বাসে নোয়াখালী থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। দৃশ্যপট একইরকম থাকলেও এবার অবস্থা আরো ভয়াবহ। যাত্রী নেওয়ার নিয়ম-নীতি মানার কোনো বালাই ছিল না। একই সারিতে চার সিটেই যাত্রী উঠিয়েছে তারা। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সুপারভাইজারকে জিজ্ঞাসা করেও কোনো উত্তর মেলেনি। বরং আমার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে একটা হাসি দিলো। মনে হলো আমি তাকে হাস্যকর কোনো প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেছি।

বিজ্ঞাপন

দুই.
সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের যে ১২ দফা নির্দেশনা দিয়েছেন সেগুলো হলো: স্বাস্থ্যবিধি, সামাজিক দূরত্ব ও শারীরিক দূরত্ব কঠোরভাবে মেনে চলতে হবে। বাস টার্মিনালে কোনোভাবেই ভিড় করা যাবে না। তিন ফুট দূরত্ব বজায় রেখে যাত্রীরা গাড়ির জন্য লাইনে দাঁড়াবেন এবং টিকিট কাটবেন। স্টেশনে পর্যাপ্ত হাত ধোয়ার ব্যবস্থা রাখতে হবে। বাসে কোনো যাত্রী দাঁড়িয়ে যেতে পারবেন না। বাসের সব সিটে যাত্রী নেওয়া যাবে না। ২৫-৩০ শতাংশ সিট খালি রাখতে হবে। পরিবারের সদস্য হলে পাশের সিটে বসানো যাবে, অন্যথায় নয়। যাত্রী, চালক, সহকারী, কাউন্টারের কর্মী সবার জন্য মাস্ক পরিধান বাধ্যতামূলক। ট্রিপের শুরুতে এবং শেষে বাধ্যতামূলকভাবে গাড়ির ভেতরসহ পুরো গাড়িতে জীবাণুনাশক স্প্রে করতে হবে। যাত্রী ওঠা-নামার সময় শারীরিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে হবে। যাত্রীদের হাত ব্যাগ, মালামাল জীবাণুনাশক দিয়ে স্প্রে করতে হবে।

এখন প্রশ্ন হলো, এই ১২ দফা নির্দেশনার কোনোটা কি দেশের গণপরিবহনগুলো মানছে? আমার অভিজ্ঞতা বলছে, না, মানছে না।

তিন.
করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে ক্ষতির অজুহাত দেখিয়ে বেসরকারি গণপরিবহনের মালিকেরা রাস্তায় গাড়ি নামানোর ক্ষেত্রে ভাড়া বাড়ানোর দাবি তুলেছিলেন আমাদের পাশের দেশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কাছে। কিন্তু মমতা বন্দোপাধ্যায়ের সরকার এই আবদার-চাপ কোনো কিছুতেই টলেনি। বরং সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, এই অবস্থায় ভাড়া বাড়লে দীর্ঘদিন আয়-রোজগার ছাড়া কাটানো মানুষ ভোগান্তিতে পড়বে। উপায় না দেখে শেষ পর্যন্ত পুরনো ভাড়াতেই রাস্তায় গাড়ি নামায় মালিকরা।

বিজ্ঞাপন

অথচ আমাদের দেশের চিত্র ভিন্ন। আমাদের দেশে গণপরিবহন নিয়ে জনভোগান্তি নতুন কিছু নয়। দীর্ঘদিন ধরে গণপরিবহনে নৈরাজ্য চলছে। কিন্তু এবার যেটা হলো সেটা যেন ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’। এমনিতেই নানা সুযোগে বেশি ভাড়া আদায় করতো পরিবহন সংশ্লিষ্টরা, তার উপর ৬০ শতাংশ ভাড়া বৃদ্ধির বোঝা টানতে হচ্ছে যাত্রীদের। তা করোনা মহামারিতে আর্থিক সংকটে থাকা জনগণের উপর প্রচণ্ড চাপ তৈরি করেছে। যাত্রীদের যাতায়াতে ব্যয় বেড়ে গেছে, স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত হচ্ছে না। আবার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে বর্ধিত ভাড়া কতটা ‘স্বাভাবিক’ হবে, সেই প্রশ্নটাও থেকে যাচ্ছে। অতীতে আমরা বাস ভাড়া কমার নজির দেখিনি। এবারও তার পুনরাবৃত্তি হলে দুঃসময়ে ‘সাময়িক’ ভাড়া বৃদ্ধি যাত্রীদের স্থায়ী দুর্ভাগ্য হয়েই থাকবে। কোনো কোনো জায়গায় ৬০ শতাংশের বেশিও ভাড়া নেওয়া হচ্ছে।

নির্দেশনা ছিল অর্ধেক আসন ফাঁকা রাখার। এর বাইরে যাত্রী-চালকদের মাস্ক-গ্লাভস ব্যবহার, টার্মিনালে যাত্রীদের হাত ধোয়ার ব্যবস্থা রাখাসহ বেশ কিছু নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল। অনেক যাত্রী যেমন স্বাস্থ্যবিধি মানতে চাইছেন না, তেমনি পরিবহন শ্রমিকদের মধ্যেও স্বাস্থ্যবিধি মানতে অনীহা দেখা যাচ্ছে। কোথাও কোথাও আবার সরকার নির্ধারিত ভাড়ার চেয়েও বাড়তি ভাড়া আদায়ের অভিযোগ উঠেছে পরিবহন শ্রমিকদের বিরুদ্ধে। গণপরিবহনে স্বাস্থ্যবিধি না মানার কারণে করোনাভাইরাস সংক্রমের ঝুঁকি আরো বাড়ছে বলে অভিমত সংশ্লিষ্টদের।

বিভিন্ন গণমাধ্যম থেকে জানা যায়, ঢাকায় বাসে সবচেয়ে বেশি ভিড় হচ্ছে বিকালে অফিস ছুটির সময়। ফলে সুযোগটা কাজে লাগিয়ে বাসের সব আসন তো বটেই, দাঁড়ানো যাত্রীও তোলা হচ্ছে বাসে। ট্রিপ শেষে গাড়িতে জীবাণুনাশক স্প্রে ছিটানোর নির্দেশনা থাকলেও তা মানছেন না অধিকাংশ পরিবহন শ্রমিক। ঢাকার ভেতরে চলাচলকারী যেসব লোকাল বাস আছে, সেগুলোতে যারা উঠছেন, তাদের অনেককেই টেনে তুলছেন গাড়ীর হেলপাররা। সবচেয়ে চোখে পড়ার মতো বিষয়টি হচ্ছে, যাত্রীরা বাসে ওঠা এবং নামার সময় গেটের সামনেই এসে জড়ো হচ্ছেন। আর একই হাতল সবাই স্পর্শ করছেন, কিন্তু কারো হাতে কোনো গ্লাভস নেই।

কোথায় স্বাস্থ্যবিধি, কোথায় সীমিত যাত্রী! সরকারের শর্তসাপেক্ষে গণপরিবহন চালুর কথা থাকলেও তা কোনোভাবেই বাস্তবায়ন হয়নি। বাস তো আগের মতোই চলছে গাদাগাদি করে। বর্তমানে লঞ্চঘাট, বাসস্ট্যান্ড, টার্মিনাল ও রাস্তঘাটের দৃশ্য ভয়াবহ। কোথাও স্বাস্থ্যবিধি মানার ন্যুনতম বালাই নেই। দূরপাল্লার বাসগুলোতে ঠেলাঠেলি করে মানুষ ভেতরে ঢুকছে। কোনো কোনো বাসে ছাদের উপরেও যাত্রী তোলা হচ্ছে। লঞ্চে সামাজিক দূরত্ব বজায় থাকা দূরে থাক, সেখানে মানুষের উপচেপড়া ভিড়। পরিবহনগুলোতে স্বাস্থ্যবিধি পালন হচ্ছে কিনা সেটি দেখার জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর কোনো মনিটরিং চোখে পড়ছে না। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগছে, এগুলো দেখার জন্য কোনো কর্তৃপক্ষ কি আছে?

বিজ্ঞাপন

দেশের চলমান করোনা পরিস্থিতির মধ্যে চালু হওয়া গণপরিবহনে স্বাস্থ্যবিধির শর্তগুলো যারা মানবেন না তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানিয়েছিলেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। কিন্তু এক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছে বলা যায়। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মমতার সরকার যদি সেখানকার নৈরাজ্য ঠেকাতে অনড় থাকতে পারেন, আমাদের দেশের সরকার কেনো পারছেন না, প্রশ্নটা থেকেই যাচ্ছে। গলদটা আসলে কোথায়?

নিশ্চয়ই সরকার পরিবহন নৈরাজ্যের কাছে অসহায়। এটা দীর্ঘদিন ধরে আমরা লক্ষ্য করে আসছি; দেশের পরিবহন সেক্টরের অন্যায্য আবদারের কাছে সরকার সবসময় জিম্মি কিংবা নতজানু হয়ে আসছে। আসলে সরকার সিন্ডিকেটের কাছেই আত্মসমর্পণ করেছে; এটা বলাই বাহুল্য।

চার.
গণপরিবহন ব্যবহারে যাত্রীরা সর্বোচ্চ সতর্কতা ও কঠোর স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ না করলে করোনাভাইরাসের ভয়াবহ বিস্তার ঘটতে পারে। এ আশঙ্কা আছে বলেই দুই মাসের বেশি সময় গণপরিবহন চলাচল বন্ধ ছিলো। গণপরিবহন চালু হওয়ার পর থেকে করোনাভাইরাস সংক্রমণের উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছেন যাত্রীরা। এভাবে ভাইরাস ছড়াতে পারে সর্বত্র। এ মহামারি ঠেকাতে সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে বটে কিন্তু কোনোটিরই সুফল নেই। উপরন্তু শক্তিশালী পরিবহন ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজরদারির অভাবে সংক্রমনের ভয়াবহতা আরও বাড়ছে।

গণপরিবহনে স্বাস্থ্যবিধি মানা-না মানা বস্তুত গোটা গণপরিহন ব্যবস্থায় সাময়িক হলেও যাত্রীবান্ধব নীতি গ্রহণ করা উচিত। একইসঙ্গে যে চার শর্তে বাস পরিচালনার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে, তাও মানতে হবে কঠোরভাবে। দূরপাল্লা বা সিটিং বাসে যত্রতত্র যাত্রী তোলা, নামানো বা দাঁড় করিয়ে নেওয়া আগেও নিষিদ্ধ ছিল; কিন্তু তা সামান্যই প্রতিপালিত হতো। করোনাকালেও যদি একই প্রবণতা অব্যাহত থাকে, তা হবে যাত্রী ও বাস শ্রমিক নির্বিশেষে সবার জন্য আত্মঘাতী। আর অর্ধেক আসন ফাঁকা রাখার নিয়মও যদি মানা না হয়, তবে তা হবে যাত্রীদের জন্য পয়সা দিয়ে রোগ কেনার নামান্তর। সঠিক মনিটরিং থাকলে গণপরিবহনে উপেক্ষিত স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলবে, একইসঙ্গে করোনা সংক্রমনের ভয়াবহতা অনেকটাই ঠেকানা সম্ভব হবে।

লেখক: সভাপতি, বাংলাদেশ যুব ইউনিয়ন, ঢাকা মহানগর

সারাবাংলা/এসবিডিই

প্রিয় পাঠক, লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই ঠিকানায় -
sarabangla.muktomot@gmail.com

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত মতামত ও লেখার দায় লেখকের একান্তই নিজস্ব, এর সাথে সারাবাংলার সম্পাদকীয় নীতিমালা সম্পর্কিত নয়। সারাবাংলা ডটনেট সকল মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তবে মুক্তমতে প্রকাশিত লেখার দায় সারাবাংলার নয়।

Tags: , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন