বিজ্ঞাপন

আলো ছড়াতে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত প্রয়োজন

October 17, 2020 | 3:12 pm

কবীর চৌধুরী তন্ময়

ব্যক্তিগতভাবে প্রচন্ড আশাবাদী মানুষ আমি। বাবার কাছ থেকেই শুনেছি মুক্তিযুদ্ধের গৌরবগাঁথা ইতিহাস। বড় কাকার হাত ধরে মুক্তিযুদ্ধে চলে যাওয়া, ভারতের কোথায় কীভাবে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন, সময় পেলেই বাবা আমাদের বলেছেন, কীভাবে পনের-ষোলো বছরের যুবক অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছেন, সেই স্কুল জীবনের শুরু থেকেই আমাদের জানিয়েছেন। বড় কাকার প্রথম মেয়ে সন্তান বংশের প্রদীপ হয়ে সংসার-সমাজ আর পৃথিবীকে আলোকিত করে জন্মগ্রহণ করার খবরে তিনি আর অপেক্ষায় থাকতে পারেননি। চারপাশে স্বাধীনতাবিরোধী শত্রু, রাজাকার, আলবদর, আলসামস! তারপরেও মেয়েকে এক নজর দেখার জন্য, হাতে নিয়ে একটু আদর করার জন্য, স্পর্শ করে বাবা হিসেবে নিজেকে গর্বিত করার স্বপ্ন নিয়ে রাতের অন্ধকারে ছুটে আসেন। প্রিয় মেয়ে সন্তানকে কোলে তুলে নিতেই রাজাকার, আলবদর, আলসামস ঘেরাও করে হাত থেকে বাচ্চাকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে লাশ গুম করে ফেলে, যার সন্ধান আজও মেলেনি।

বিজ্ঞাপন

১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করে একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রকে কিভাবে সাম্প্রদায়িক করা হয়েছে, সংবিধান থেকে আরম্ভ করে রাষ্ট্রযন্ত্র, সরকার কাঠামোসহ এমন কোনও অবকাঠামো-প্রতিষ্ঠান নেই যেখানে সাম্প্রদায়িক বীজ বপন করা হয়নি! একটি জাতিকে, জাতির ভবিষ্যত প্রজন্মকে সাম্প্রদায়িক চিন্তা-দর্শনে মানবতার বিরুদ্ধে বিপদজনক পথে ঠেলে দিতে পাঠ্যপুস্তকের পাতায় পাতায় জুড়ে দেওয়া হয়েছে মিথ্যাচার, ইতিহাস বিকৃতির চুড়ান্ত কলাকৌশল!

আজ জাতির একটা অংশ সেই কলাকৌশলের ফলাফল। সত্য জানার পরেও মানার ক্ষমতা তাদের নেই। তথ্য-প্রমাণ হাতে থাকার পরেও মিথ্যাচার আর অপপ্রচারকেই যেন প্রাধান্য দিচ্ছে তারা। পুরো পৃথিবী হাতের মুঠোয়, ইচ্ছে করলে কুখ্যাত রাজাকার দেলওয়ার হোসাইন সাঈদীর চাঁদে যাওয়ার মিথ্যা গল্পটি বিশ্বাস করার আগেই যাচাই-বাছাই করতে পারে, কোনটা ইসলাম আর কোনটা ইসলাম বিদ্বেষ-এটিও ব্যাখ্যাসহকারে নিজেরাই খতিয়ে দেখতে পারে। কিন্তু দুঃখজনক হলো, তাদের পরিবার সেই শিক্ষা দিতে ব্যর্থ হয়েছে বলেই তারাও তাদের অভিভাবকদের মতই বিভ্রান্ত!

৭৫’ পরবর্তী প্রজন্মের বয়স আজ পয়তাল্লিশ। তাদের সন্তানদের অনেকের বয়স স্কুল, কলেজ পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গন। আবার এমন অনেকের সন্তানদের দেখেছি, তারাও বিয়ে করে সন্তানের বাবা হয়েছেন। ইতিহাসে এ বাংলার মীরজাফর খন্দকার মোশতাক আহমেদ ও জিয়াউর রহমান অবৈধভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে বাংলাদেশে যে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিষবাষ্প ছড়িয়েছে, তারই ফলশ্রুতি আজকের প্রজন্মের একটা অংশ।

বিজ্ঞাপন

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের সংবিধান প্রণীত হয়, যা কার্যকর হয় ঐ বছরেরই ১৬ ডিসেম্বর থেকে। সেই সংবিধানের রাষ্ট্র পরিচালনার চারটি মূলনীতি ছিলো- ১. জাতীয়তাবাদ, ২. গণতন্ত্র, ৩. সমাজতন্ত্র এবং ৪. ধর্মনিরপেক্ষতা। সংবিধানের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা।

অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, অবৈধভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে জিয়াউর রহমান সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের শুরুতে প্রস্তাবনার আগেই ‘বিসমিল্লাহির রহমানির রাহিম’ (দয়াময়, পরম দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু করলাম) এই কথাটি সংযোজন করেন। তার ধারাবাহিকতা রক্ষার্থে আরেক স্বৈরশাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ ১৯৮৮ সালে বাংলাদেশের সংবিধানের মূল চরিত্রটিই পরিবর্তন করেন। স্বাধীনতাবিরোধী আর মৌলবাদ চিন্তা-দর্শন বাস্তবায়ন করতেই পরিকল্পিতভাবে সংবিধানে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেন।

দুই স্বৈরশাসক জিয়াউর রহমান আর হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের হাত দিয়ে যে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি শুরু হয়েছিল, সেটা প্রকাশ্যে রীতিমত জোটবদ্ধ হয়ে খালেদা জিয়াও একই ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে। শুধু তাই নয়, রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়ে এদেশের রাজাকার, আলবদর, আলসামস যুদ্ধাপরাধী-মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বাঁচাতে মাঠে-ময়দানে আন্দোলন-সংগ্রামও করেছে। দেশের অভ্যন্তরে ষড়যন্ত্রের পাশাপাশি বিদেশী রাষ্ট্র-সরকার প্রধানদের দিয়েও ওইসব ঘৃণ্য অপরাধীদের বাঁচানোর নোংরা ষড়যন্ত্র করেছেন!

বিজ্ঞাপন

এই যে ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৯৬ সাল। আবার ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিশাল সময়জুড়ে যে জেনারেশন মিথ্যাচার, সাম্প্রদায়িক রাজনীতি আর ইতিহাস বিকৃতির অপচর্চার মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠেছে, তারা নিজেদের একান্ত প্রচেষ্টায় কিংবা বর্তমান তথ্য-প্রবাহের আধুনিক যুগে এসেও নিজেকে গড়ে তুলতে পারেনি। আবার হাতের মুঠোয় তথ্য-প্রমাণের ভীড়েও নিজেকে জাগ্রত করতে ব্যর্থ হয়েছে। আর তাদের পরবর্তী প্রজন্মও একই ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে।

ভুলে গেলে চলবে না যে, রাজাকার মানে-রাজার নীতি! এদেশে কখনো যুদ্ধাপরাধ হয়নি। আলেম-ওলামারা ইসলামের পথে থেকেছে, নৈতিকতার দিক থেকে পাকিস্তানকে সমর্থন করলেও কোনো গণধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, গণহত্যা করেনি, আওয়ামী লীগ মানে ভারতের দালাল, শেখ হাসিনা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এলে মসজিদ ভেঙে মন্দির করবে, শেখ হাসিনা মূলত হিন্দুর জন্ম-এইসব বিকৃত গালগল্প একশ্রেণির মানুষের মন-মগজের প্রতিস্থাপন করেছে পরিকল্পিতভাবেই! আর এই মিথ্যা গালগল্প থেকে না দেশের একশ্রেণির জনগণ বের হতে পেরেছে, না তাদের সন্তানদের আলোর পথ দেখাতে সক্ষম হয়েছে।

১৯৭৩ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত সুইডেনে যৌন অপরাধের জন্য দোষী প্রমাণিত হওয়া ২১ হাজার ৫৬৬ জন পুরুষের নানা তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখেছেন, যৌন অপরাধে দোষী প্রমাণিত হওয়া ওই পুরুষদের ভাই বা বাবাদের মধ্যে ২.৫ শতাংশ নিজেরাও এমন অপরাধে দোষী প্রমাণিত হয়েছেন। ধর্ষণ এবং শিশু নিপীড়নের মতো দুই ধরনের যৌন অপরাধের ক্ষেত্রেই এই প্রবণতা একই রকম বলে তাদের গবেষণায় তুলে ধরেছেন।

স্টকহোমের ক্যারোলিনস্কা ইনস্টিটিউটের সাইকিয়াট্রিক এপিডেমিয়োলজির অধ্যাপক নিকোলাস ল্যাংস্ট্রম বলছেন, ‘আমাদের গবেষণায় দেখা যাচ্ছে যে, পারিবারিক ঝুঁকিটা সব সময়ই থেকে যাচ্ছে। যৌন অপরাধের ‘জিন’ বলে সুনির্দিষ্ট কোনও জিনের প্রমাণ নেই। কিন্তু আবেগ নিয়ন্ত্রণ, বুদ্ধিমত্তা ও যৌন ক্ষুধার সঙ্গে সম্পর্কিত একদল জিনই আসলে কোনো ব্যক্তির এমন অপরাধের প্রবণতার জন্য দায়ী।’

বিজ্ঞাপন

অর্থাৎ, অপরাধ প্রবণতা পারিবারিক শিক্ষা-দীক্ষা আর মূল্যবোধের উপর অনেকটা নির্ভর করে। বিশেষ করে, ওই পরিবারের পূর্বপুরুষদের মানসিকতায় যদি নির্যাতন থাকে, তাহলে উত্তম পুরুষ বা চলতি কথায় নব্য প্রজন্মের মধ্যেও সেই মানসিকতার প্রভাব পড়ে কিংবা ঝুঁকি থাকে শতভাগ। আর এটাই দেখা যাচ্ছে আমাদের সমাজ-সভ্যতায়!

সাম্প্রতিক সোশ্যাল মিডিয়াতে যে ধরণের মন্তব্য, স্ট্যাটাস, ছবি আর ভিডিও ভাইরাল হয়েছে-এটি তাদের নিজস্ব সত্তার প্রতিচ্ছবি। সমাজ-রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠিত এবং সেলিব্রিটি মানুষগুলো যখন অপরাধ বা যৌন অপরাধ সংঘঠিত হতে নারী ও নারীর পোশাককে দায়ী করে, যখন কোনো ছাত্রনেতা কোনো নারীকে দুশ্চরিত্রা বলে সমাজ-রাষ্ট্রে নারীর বিরুদ্ধে অপরাধকে উসকে দেয়, তখন তাদের অতীত কিংবা পারিবারিক কৃষ্টি কালচার, ইতিহাস-ঐতিহ্য আর শিল্প-সাহিত্য চর্চার বিষয়টি ফুটে উঠে।

আর এ জায়গায় রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের প্রয়োজন। স্বৈরশাসক জিয়াউর রহমান, হুসেই মুহাম্মদ এরশাদ আর খালেদা জিয়ার শাসনামলে রাজনৈতিকভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে সাম্প্রদায়িক সমাজ-রাষ্ট্র গঠনে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এখানেই আবার রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়ে দল ও মতের উর্ধ্বে উঠে মানুষ, মানবতাবোধ নিশ্চিত করতে দেশের জনগণের সাথে-সাথে আগামীর প্রজন্মকে আলোর পথে নিয়ে যেতে সার্বজনীন শিক্ষা আর সঠিক ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক চর্চায় অভ্যস্ত করাতে হবে। প্রতিটা মানুষের ভেতর মূল্যবোধ জাগ্রত করতে হবে।

রাষ্ট্র ইচ্ছে করলে অসাধ্য সাধন করার ক্ষমতা রাখে। কারণ, রাষ্ট্রযন্ত্র; রাষ্ট্র-সরকার দ্বারা পরিচালিত। প্রয়োজন ঐক্যমত, গবেষণা আর সময়োপযোগি সিদ্ধান্ত। মনে রাখতে হবে, বন্যতা থেকে বর্বরতা আর বর্বরতা থেকে মানুষ ধীরে ধীরে সুশৃংঙ্খল জীবন-যাপনে এগিয়ে এসে সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক কর্মকন্ড দ্বারা তাদের জীবন প্রবাহের মান আজ উন্নত করেছে। অভিধানের ভাষায়, সভ্য জাতির জীবনযাত্রা নির্বাহের পদ্ধতি, সাহিত্য, শিল্প, বিজ্ঞান, দর্শন, ধর্ম ও বিদ্যার অনুশীলনহেতু মন ও মগজের উৎকর্ষ সাধন করাই হচ্ছে সভ্যতা। যদিও মানুষের মন মগজে কী হচ্ছে-এটি দৃশ্যমান নয়। তবে এই মন-মগজে আলো ছড়াতে হলে সুশিক্ষা আর শিল্প-সাহিত্য চর্চার বিকল্প নেই। আর এখানেই রাজনৈতিক দীর্ঘ মেয়াদী সিদ্ধান্তের প্রয়োজন।

লেখক: সভাপতি, বাংলাদেশ অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট ফোরাম (বোয়াফ)

সারাবাংলা/আরএফ

Tags: , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন