বিজ্ঞাপন

জিইডি’র প্রতিবেদন: দেশে দ্রুত নগরায়নে ৭ চ্যালেঞ্জ

October 28, 2020 | 9:25 pm

জোসনা জামান, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নতি গতিশীল হওয়ার পেছনে দ্রুত নগরায়নের বিষয়টি প্রভাবক হিসেবে কাজ করছে। তবে নগরায়নের গতি আরও দ্রুত করে বাংলাদেশকে দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশে পরিণত করতে চাইলে কিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে। এ ক্ষেত্রে সাতটি চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করেছে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ (জিইডি)।

বিজ্ঞাপন

টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) মূল্যায়ন সংক্রান্ত এক প্রতিবেদনে এই চ্যালেঞ্জগুলোর কথা তুলে ধরা হয়েছে। জিইডি যে চ্যালেঞ্জগুলোর কথা বলছে সেগুলো হলো— পর্যাপ্ত পরিমাণে নিরাপদ ও সাশ্রয়ী আবাসন; সাশ্রয়ী, সহজলভ্য ও টেকসই নগর পরিবহন; বায়ুমানের উন্নয়ন ঘটানো; নগরে অভিঘাত সহনশীলতা; সম্পদের সীমাবদ্ধতা; ঢাকা ও অন্যান্য শহরে প্রধান প্রধান অংশীজনের মধ্যে সমন্বয় সাধান; এবং নীতি, কৌশল ও মহাপরিকল্পনার মধ্যে ছন্দ তৈরির মাধ্যমে সমন্বয় করা।

প্রতিবেদনটি তৈরির দায়িত্বে ছিলেন জিইডির সদস্য ড. শামসুল আলম। এ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি সারাবাংলাকে বলেন, পৃথিবীতে জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি মানুষের বসবাস শহরে। ২০৫০ সাল নাগাদ তাদের দুই-তৃতীয়াংশ বা সাড়ে ছয়শ কোটি মানুষ শহরে বাস করবে। শহরের বিদ্যমান নির্মাণশৈলী ও ব্যবস্থাপনার তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন ছাড়া টেকসই উন্নয়ন অর্জন সম্ভব নয়। ফলে দ্রুত নগরায়ন ও নগরবাসীদের জীবনযাপনের জন্য উন্নত ও টেকসই একটি ব্যবস্থা গড়ে তোলার দিকে মনোযোগী হতেই হবে।

ড. শামসুল আলম আরও বলেন, বর্ধনশীল জনসংখ্যা ও অভিবাসনের ফলে শহরগুলোর দ্রুত বিস্তৃতি ঘটছে। ফলে যেমন মেগাসিটি বাড়ছে, তেমনি এর আরেক অংশে হচ্ছে বস্তি। শহরকে টেকসই করার অর্থ ব্যবসা-বাণিজ্য ও কর্মসংস্থানের সুযোগ, নিরাপদ ও সাশ্রয়ী আবাসন এবং অভিঘাত সহিষ্ণু সমাজ ও অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা। এর আওতায় আরও রয়েছে গণপরিবহণ বিনিয়োগ, সবার জন্য সবুজ খোলা চত্বর তৈরি এবং অংশগ্রহণ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক পথ অবলম্বনে নগর পরিকল্পনা উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা।

বিজ্ঞাপন

এসব বিষয়ে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের শহরের সামনেও অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে জানিয়ে ড. শামসুল বলেন, এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার নেওয়া হয়েছে বিভিন্ন পরিকল্পনা।

বাংলাদেশে নগরায়নে যে ৭ চ্যালেঞ্জ

পর্যাপ্ত, নিরাপদ ও সাশ্রয়ী আবাসন

বাংলাদেশে নগরায়নের ক্ষেত্রে প্রথম যে চ্যালেঞ্জ জিইডি চিহ্নিত করেছে, সেটি হলো আবাসন। সাশ্রয়ী আবাসনের বাড়তি চাহিদা মেটানো, বিশেষ করে বিশ্বব্যাপী ১০০ কোটির মতো নগর দরিদ্র, যারা অনানুষ্ঠানিক আবাসস্থলে থাকে, তাদের আবাসনের চাহিদা মেটানো একটি বড় চ্যালেঞ্জ। কিন্তু ভবিষ্যৎ স্থিতিশীলতার জন্য মৌলিক অবকাঠমো-সংবলিত একটি টেকসই শহর উন্নয়ন করা খুব জরুরি। সরকার আবাসন সমস্যা দূর করতে অনেক কার্যক্রম হাতে নিলেও এগুলোর বাস্তবায়ন খুবই চ্যালেঞ্জিং। দ্রুত ও অপরিকল্পিত নগরায়ন, উচ্চ জনঘনত্ব ও বিশেষ করে সম্পদের সীমাবদ্ধতা এর অন্যতম কারণ।

বিজ্ঞাপন

সাশ্রয়ী, সহজলভ্য ও টেকসই নগর পরিবহন

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সহজলভ্য গণপরিবহন ব্যবহারের সুযোগ পাওয়া মানুষের অনুপাত এখনো কম। কারও আবাসস্থল থেকে বাসস্টপ পর্যন্ত আধা কিলোমিটারের হাঁটা পথ। ট্রেন কিংবা ফেরি টার্মিনাল থেকে এ দূরত্ব এক কিলোমিটার হলে তা সহজলভ্য গণপরিবহন হিসেবে সংজ্ঞায়িত হয়। ২০১৮ সালে ৭৮টি দেশের ২২৭টি শহরের উপাত্তে দেখা যায়, সব অঞ্চলে গড়ে ৫৩ শতাংশ মানুষের গণপরিবহনে ওঠার ভালেণা সুযোগ রয়েছে। এ হার আফ্রিকার সাব-সাহারা অঞ্চলে সর্বনিম্ন ১৮ শতাংশ এবং সবচেয়ে বেশি অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডে— ৭৫ শতাংশ। যেসব এলাকায় গণপরিবহনে প্রবেশাধিকার কম, সেখানে অনানুষ্ঠানিক পরিবহন মাধ্যমের প্রসার বেশি এবং সেগুলোই শহরের সিংহভাগ বাসিন্দাদের যাতায়াতের নির্ভরযোগ্য মাধ্যম।

পরিবহন ব্যবস্থার অগ্রগতি, প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন ও ভবিষ্যৎ পরিবর্তন নিয়ে পরিবহন খাত, বিশেষ করে নাগরিক পরিবহন গভীর চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে যাচ্ছে। পরিবেশের ক্ষতি না করে সম্ভাব্য ন্যূনতম সামাজিক ব্যয়ে ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্বব্যাপী শহরের প্রায় ছয়শ কোটি বাসিন্দার বাড়তি পরিবহন চাহিদা কিভাবে মেটানো যায়, তা দেখার বিষয়। এ ক্ষেত্রে সরকারি নীতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে ভবিষ্যতের সম্ভাব্য সমাধান নির্ধারণে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০৩৫ সাল নাগাদ পাঁচটি মেট্রোরেল সংযোগ, দু’টি বাস র‌্যাপিড রুট, ১২শ কিলোমিটার নতুন রাস্তা, ছয়টি ফ্লাইওভার ও তিনটি রিং রোড নির্মাণের পর ঢাকা শহরের পরিবহন ব্যবস্থা ব্যাপকভাবে উন্নত হবে। ২০১৫-২০৩০ মেয়াদে বাস্তবায়নাধীন রয়েছে সংশোধিত কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা ২০১৬। অগ্রাধিকারের অন্তর্ভুক্ত রয়েছে রাজধানীর সড়ক উন্নয়ন এবং সমন্বিত গণপরিবহন ব্যবস্থা। এছাড়া পরিবহন নিরাপত্তা অব্যবস্থাপনা বিষয়টি চিহিৃত করা হয়েছে উন্নয়নের জন্য।

বিজ্ঞাপন

বায়ুমানের উন্নয়ন ঘটানো

বায়ুদূষণ মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর এবং তা দিন দিন মৃত্যুর বড় কারণে পরিণত হচ্ছে। বৈশ্বিক বায়ু পরিস্থিতি ২০১৯ শীর্ষক আন্তর্জাতিক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে— বায়ুদূষণের কারণে দেশে অন্তত এক লাখ ২৩ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে। নগরায়ন ও অবকাঠামো নির্মাণের সময় শুষ্ক মৌসুমে বায়ুদূষণের মাত্রা অন্য সব সময়কে ছাড়িয়ে যায়। এর প্রধান কারণের মধ্যে আরও রয়েছে শিল্প নির্গত দূষণ, যানবাহনের ধোঁয়া ও বর্জ্য পোড়ানো।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আইন থাকলেও ঢাকা শহরের আশপাশে বেশকিছু ইট ভাটা এখনো পরিচালিত হচ্ছে, যা ঢাকার ৫২ শতাংশ দূষণের জন্য দায়ী। তবে সরকারের প্রচেষ্টায় প্রায় ৬০ শতাংশ ইট ভাটা কার্যকর জ্বালানি ব্যবহার শুরু করেছে। এ বিষয়ে সরকার নজরদারিও করছে। এছাড়া অনিবন্ধিত ইটভাটাগুলোর কার্যক্রম বন্ধের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বায়ু দূষণ রোধের ক্ষেত্রে অদক্ষ উপায়ে জ্বালানি পুড়িয়ে দূষিত কণা উৎপাদনকারী আনফিট বা পুরোনো বাহন সরিয়ে নেওয়ার কথাও বলা হয়েছে প্রতিবেদনে।

নগরে অভিঘাত সহনশীলতা

দরিদ্র গ্রামীণ জনগোষ্ঠী যারা বিভিন্ন শহরে পরিযায়ী হয়, তাদের মধ্যে বেশিরভাগই ঢাকামুখী। ঢাকায় আসা পরিযায়ীরা প্রধানত পরিবেশগত চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। তারা উপকূল ও হাওর সংক্রান্ত পরিবেশগত ঝুঁকি দুর্যোগ, মঙ্গা ও নদী ভাঙনের শিকার হয়। জলবায়ু পরিবর্তন, বন্যা ও আকস্মিক বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ পরিস্থিতিকে আরও খারাপের দিকে নিয়ে যায়। ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস, লবণাক্ততার অনুপ্রবেশ এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি উপকূলীয় এলাকার লাখ লাখ মানুষকে ঢাকামুখী হতে বাধ্য করবে।

এ পরিস্থিতি উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকার ওপর থেকে চাপ কমাতে সেকেন্ডারি বা মাধ্যমিক শহর গড়ে তোলা প্রয়োজন, যেগুলো হবে অভিঘাত সহনশীল ও পরিযায়ীবান্ধব। সরকার নাগরিক সেবা দিচ্ছে উপজেলা সদর দফতর থেকে, যেন এগুলো ক্ষুদ্র শহর হিসেবে বেড়ে উঠতে পারে এবং গ্রামীণ প্রবৃদ্ধি সেন্টারগুলোকে কেন্দ্র করে আবাসন গড়ে ওঠে।

সম্পদের সীমাবদ্ধতা

দেশে দ্রুত নগরায়ন ও সার্বিক আর্থসামাজিক উন্নতি সাম্প্রতিক বছরগুলোর আরও উন্নত নাগরিক সেবার চাহিদা বাড়িয়েছে। জিইডির এসডিজি অর্থায়ন কৌশল ২০১৮-এর মূল্যায়ন অনুযায়ী, এসডিজি ১১ সংক্রান্ত প্রকল্প বাস্তবায়নে ২০২০ সাল নাগাদ অতিরিক্ত ২৬ কোটি মার্কিন ডলার, ২০২৫ সাল নাগাদ ২৮ কোটি মার্কিন ডলার ও ২০৩০ সাল নাগাদ ৩৪ কোটি মার্কিন মিলিয়ন ডলার প্রয়োজন হবে। এ অর্থের ২০ শতাংশ সরকারি খাত থেকে ৬০ শতাংশ বেসরকারি খাত থেকে এবং ২০ শতাংশ পিপিপি থেকে জোগাড় হবে।

ঢাকা ও অন্যান্য শহরে প্রধান প্রধান অংশীজনের মধ্যে সমন্বয়

শহর এলাকায় অনেক সেবা সরবরাহকারী সংস্থা ও অংশীজন রয়েছে। বাংলাদেশের অনেক নগর এলাকায় জলবিদ্যুৎ, গ্যাস সংযোগ এবং নর্দমা ও নিষ্কাশন ব্যবস্থার অনিশ্চয়তা রয়েছে। বাংলাদেশ ২০৩১ সাল নাগাদ উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছে। সেক্ষেত্রে শহরকে আরও বেশি জনবান্ধব হতে হবে এবং এর জন্য সেবা সরবরাহকারী সংস্থাগুলোসহ বিভিন্ন অংশীজনের মধ্যে আরও বেশি সমন্বয় প্রয়োজন হবে।

নীতি, কৌশল ও মহাপরিকল্পনার মধ্যে ছন্দ তৈরি করা

সিটি করপোরেশন এলাকায় কার্যক্রম পরিচালনাকারী প্রায় সব সংস্থার নিজস্ব উন্নয়ন নীতি, কৌশল ও মহাপরিকল্পনা রয়েছে। এই মহাপরিকল্পনাগুলোর মধ্যে প্রায়ই সমন্বয় থাকে না। ফলে কর্মসূচি বাস্তবায়নের সময় একটির সঙ্গে আরেকটির বৈপরীত্য দেখা দেয়। এতে করে অনেক সময় জনদুর্ভোগ তৈরি হয়। অথচ এই সংস্থাগুলোর মধ্যে সুসমন্বয় তৈরি করা সম্ভব হলে সেই দুর্ভোগ যেমন এড়ানো যায়, তেমনি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ সম্পদের অপচয়ও কমানো সম্ভব।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বব্যাপী বস্তিতে বসবাসকারী মানুষের অনুপাত কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। তা সত্ত্বেও শহরের বাসিন্দাদের মধ্যে অনেকেই দূষিত বাতাসে শ্বাস নিতে বাধ্য হচ্ছেন। উম্মুক্ত জায়গা ও পরিবহনে প্রবেশাধিকার সীমিত থাকছে। ক্রমেই জনসংখ্যার অনুপাতে শহরে পরিণত হওয়া এলাকার পরিসর বাড়ছে। ফলে তা টেকসই না হওয়ার যথেষ্ট শঙ্কা রয়েছে। চলমান বাস্তবতায় আপাতত প্রতিবেদনে উঠে আসা সাতটি চ্যালেঞ্জ সফলভাবে মোকাবিলা করা সম্ভব হলে মধ্য আয়ের দেশ হওয়ার পথে বাংলাদেশের যে যাত্রা, সেটি অনেক বেশি টেকসই হবে বলে মনে করছে জিইডি।

সারাবাংলা/জেজে/টিআর

Tags: , , , , , , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন