বিজ্ঞাপন

উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় করোনার ‘থাবা’

December 31, 2020 | 7:56 pm

জোসনা জামান, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) থাবায় উল্টে গেছে গোটা বিশ্বের সব হিসাব-নিকাশ। অন্য সব দেশের মতো বাংলাদেশও এই ভাইরাসের কড়াল থাবা থেকে মুক্তি পায়নি। ফলে একই সরকার টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় থাকায় গত কয়েক বছর ধরে দেশে উন্নয়নের যে ধারাবাহিকতা তৈরি হয়েছিল, করোনার কারণে সেই ধারাবাহিকতায় ছেদ পড়েছে। করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতিতে গত ২০১৯-২০ অর্থবছর এবং চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে সার্বিক উন্নয়ন কার্যক্রমে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব দেখা গেছে। বর্তমানে অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলেও আগের অবস্থায় ফিরতে পারেনি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের গতি।

বিজ্ঞাপন

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, গত জুন মাসে শেষ হওয়া ২০১৯-২০ অর্থবছরে খরচ করা যায়নি  ৩৯ হাজার ৬৭২ কোটি টাকা। আর চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) বাস্তবায়ন হার ছিল মাত্র ১২ দশমিক ৭৯ শতাংশ। এসময় খরচ হয়েছে ২৭ হাজার ৪৫৩ কোটি টাকা। অথচ গত অর্থবছরের একই সময়ে এডিপি বাস্তবায়নের হার ছিল ১৪ দশমিক ২৫ শতাংশ, ব্যয় হয়েছিল ৩০ হাজার ৬৫২ কোটি টাকা।

এডিপি বাস্তবায়নে ধীরগতি

২০১৯-২০ অর্থবছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার ছিল দুই লাখ ১৫ হাজার ১১৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে এক লাখ ৩০ হাজার ৯২১ কোটি, বৈদেশিক সহায়তা থেকে ৭১ হাজার আটশ কোটি ও স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার নিজস্ব তহবিল থেকে ১২ হাজার ৩৯৩ কোটি টাকা খরচ ধরা হয়েছিল। মাঝ পথে এসে গত মার্চ মাসে কাটছাঁট করে বরাদ্দ কমিয়ে সংশোধিত এডিপি’র (আরএডিপি) আকার ধরা হয় দুই লাখ এক হাজার ১৯৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে এক লাখ ৩০ হাজার ৯২১ কোটি টাকা, বৈদেশিক সহায়তা থেকে ৬২ হাজার কোটি ও সংস্থার নিজস্ব তহবিল থেকে আট হাজার ২৭৭ কোটি টাকা ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়।

তবে সংশোধিত এই এডিপিও বাস্তবায়ন করা যায়নি গত অর্থবছরে। পুরো অর্থবছরে ব্যয় হয়েছে এক লাখ ৬১ হাজার ৫২৬ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। অর্থাৎ সংশোধিত এডিপি থেকেও ৩৯ হাজার ৬৭২ কোটি টাকা খরচ করা সম্ভব হয়নি। এডিপি বাস্তবায়ন না করতে পারার পেছনে মূল ভূমিকা রেখেছে করোনা সংক্রমণ। কারণ জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) বৈঠকে আরএডিপি অনুমোদন পাওয়ার পর ২৬ মার্চ থেকে দেশে শুরু হয় লকডাউন। ফলে এপ্রিল, মে ও জুন মাসে উন্নয়ন কার্যক্রম স্থবির ছিল। বেশিরভাগ প্রকল্পের কাজ একেবারেই বন্ধ হয়ে যায়। ফলে আরএডিপি বাস্তবায়নে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়ে শুধু বিল পরিশাধ ছাড়া তেমন কিছুই হয়নি। এই অর্থবছরে ১২টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের এডিপি বাস্তবায়নের হার ছিল ৬০ শতাংশের নিচে।

বিজ্ঞাপন

আরএডিপির বাস্তবায়নের করুণ চিত্র

আইএমইডি’র প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, গত অর্থবছরে আরএডিপি (সংশোধিত এডিপি) বাস্তবায়নের যে হার দাঁড়িয়েছে, তা আগের কয়েক বছরের তুলনায় সর্বনিম্ন। জুলাই থেকে জুন মাস পর্যন্ত অর্থবছরের ১২ মাসে সবকিছু মিলিয়ে অগ্রগতি দাঁড়িয়েছে ৮০ দশমিক ২৮ শতাংশ। তার আগে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এই হার ছিল ৯৪ দশমিক ৬৬ শতাংশ। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বাস্তবায়ন হয়েছে ৯৪ দশমিক ১১ শতাংশ। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৮৯ দশমিক ৭৬ শতাংশ এবং ২০১৫-১৬ অর্থবছরে সংশোধিত এডিপি বাস্তবায়ন হয়েছিল ৯২ দশমিক ৭২ শতাংশ।

চলতি অর্থবছরের মাসের চিত্র

আইএমইডি’র প্রতিবেদনে চলতি অর্থবছরের পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, চলতি অর্থবছরের এডিপিতে বরাদ্দ রয়েছে ২ লাখ ১৪ হাজার ৬১১ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারি তহবিলের ১ লাখ ৩৪ হাজার ৬৪৩ কোটি টাকা, বৈদেশিক সহায়তা থেকে ৭০ হাজার ৫০২ কোটি টাকা এবং স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব তহবিল থেকে ৯ হাজার ৪৬৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে গত জুলাই-অক্টোবর পর্যন্ত চার মাসে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো খরচ করতে পেরেছে ২৭ হাজার ৪৫৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারি তহবিল থেকে ১৮ হাজার ৩২৪ কোটি টাকা, বৈদেশিক সহায়তা থেকে ৮ হাজার ২৮৪ কোটি টাকা এবং স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের তহবিল থেকে ৮৪৫ কোটি টাকা খরচ হয়েছে।

তবে এই চার মাসের মোট ব্যয়ও গত অর্থবছরের একই সময়ে তুলনায় ৩ হাজার ১৯৯ কোটি টাকা কম। এর পেছনেও রয়েছে করোনার অভিঘাত। কেননা এখনো উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে পূর্ণগতি ফিরে আসেনি। ফলে অর্থবছর শেষে কাঙ্ক্ষিত এডিপির বাস্তবায়ন নিয়েও রয়েছে শঙ্কা।

বিজ্ঞাপন

শতাংশের নিচে ১১ মন্ত্রণালয় বিভাগ

চলতি অর্থবছরের চার মাস পেরিয়ে গেলেও এখনো ১২টি মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থার এডিপি বাস্তবায়নের হার রয়েছে পাঁচ শতাংশের নিচে। এগুলো হলো— ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ (২ দশমিক ২৮ শতাংশ), জননিরাপত্তা বিভাগ (২ দশমিক ১৫ শতাংশ), প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় (৪ দশমিক ৯৭ শতাংশ), ভূমি মন্ত্রণালয় (৪ দশমিক ৬৩ শতাংশ), জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় (১ দশমিক ৭৬ শতাংশ), অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ (শূন্য দশমিক ২৭ শতাংশ), আর্থিক প্রাতষ্ঠান বিভাগ (২ দশমিক ৯৯ শতাংশ), আইন ও বিচার বিভাগ (২ দশমিক ৯০ শতাংশ), তথ্য মন্ত্রণালয় (৪ দশমিক ৭৩ শতাংশ), পরিকল্পনা বিভাগ (৪ দশমিক ৮৫ শতাংশ) ও বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন (শূন্য দশমিক ২৮ শতাংশ)।

করোনার থাবা জিডিপি প্রবৃদ্ধিতেও

গত কয়েক বছর ধরেই দেশে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হার ছিল ঈর্ষণীয়। ২০১২-১৩ অর্থবছরে দেশে জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছিল ৬ দশমিক ০১ শতাংশ। বাড়তে বাড়তে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে এই হার প্রথমবারের মতো ৭ শতাংশ অতিক্রম করে। ওই অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল ৭ দশমিক ১১ শতাংশ। জিডিপি প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিকতা অব্যাহত ছিল পরের বছরগুলোতেও। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এই হার দাঁড়ায় ৮ দশমিক ১৫ শতাংশে। এরপর ২০১৯-২০ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৮ দশমিক ২০ শতাংশ প্রাক্কলন করা হলেও করোনার অভিঘাতে এই লক্ষ্যমাত্রার ধারেকাছেও পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর আশঙ্কা ছিল, এই হার ১ শতাংশ পর্যন্ত নেমে আসতে পারে। শেষ পর্যন্ত ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয় এই অর্থবছরে।

তবে এ অবস্থা থেকেও ঘুরে দাঁড়ানোর লক্ষ্য নিয়েছে বাংলাদেশ। কোভিড পরবর্তী উত্তরণের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৮ দশমিক ২০ শতাংশ।

করোনার ধাক্কা কাটিয়ে ওঠার আশাবাদ

করোনাভাইরাসের কারণে দীর্ঘ একটি সময় সব ধরনের কর্মকাণ্ড বন্ধ রাখতে হয়েছিল সরকারকে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই গত অর্থবছরের শেষভাগ কেবল নয়, চলতি অর্থবছরের প্রথম কয়েকমাসেও এডিপি বাস্তবায়নসহ যাবতীয় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডেই ছিল শিথিলতা। তবে স্থবিরতা কাটিয়ে ফের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সচল হয়েছে। পূর্ণোদ্যমে শুরু হয়েছে প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ। উন্নয়নে গতি আনতে ব্যাপক মনিটরিং বাড়িয়েছে আইএমইডি। সরকার আশা করছে, চলতি অর্থবছরের শেষ নাগাদ করোনা পূর্ববর্তী সময়ের ধারাবাহিকতায় ফিরে আসা সম্ভব হবে।

বিজ্ঞাপন

সারাবাংলা/জেজে/টিআর

Tags: , , , , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন