বিজ্ঞাপন

ভেসে আসে আর্তনাদ, ‘আমাকে কি একটু জল দেবে বাসন্তী’

March 25, 2018 | 6:49 pm

২৫ মার্চ, ঢাকার দিনটা ছিল কেমন যেন থমথমে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল আসে, নিভে যায় দিনের সূর্যটাও। এরপর নেমে আসে পুরো ঢাকা জুড়ে নিঃস্তব্ধ অন্ধকার। সেই রাতেই মানুষরূপী ঘাতকেরা বেরিয়ে পড়ে রাইফেল নিয়ে। জলপাই রঙের ট্রাকের হুঙ্কার ঢাকার অলিতে-গলিতে। গুলিতে জর্জরিত অগণিত মানুষের বুক।

বিজ্ঞাপন

কেমন ছিল সেই রাতের ভয়াবহ দৃশ্যপট! স্মৃতিচারণে তা অকপটে বলেছেন, ২৫ মার্চের গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী আবু মুসা ম মাসুদউজ্জামান জাকারিয়া মাসুদ। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক ও শহীদ নাসের মোহাম্মদ মনিরউজ্জামানের ছেলে। ২৫ মার্চের ঘটনা শ্রতিলিখন করেছেন কবীর আলমগীর।

‘২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর চারটি ট্রপ বের হয়। প্রথম ট্রপটি যায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাসার দিকে। দ্বিতীয় ট্রপ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, তৃতীয় ট্রপ রেসকোর্স ময়দান ও চতুর্থ ট্রপ রাজারবাগ পুলিশ লাইনের দিকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ট্রপটি আসে তা প্রথমেই ঢুকে পড়ে আমাদের আবাসিক কোয়ার্টারে। তখন আমরা শহীদ মিনার এলাকায় আবাসিক কোয়ার্টারে থাকতাম।

দেখলাম মিলিটারির গাড়ির সঙ্গে রয়েছেন বাবার সহকর্মী ও একসময়ের ছাত্র ড. ওবায়দুল্লাহ (আসকার ইবনে শাইখ) ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিসার দলিল উদ্দীনসহ চারজন।

বিজ্ঞাপন

আসকার ইবনে শাইখ সেনাবাহিনীর মাইক দিয়ে ঘোষণা করেন প্রফেসর মনিরুজ্জামান, জিসি দেব, জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা আপনারা নিচে নেমে আসুন। এভাবে একাধিকবার ঘোষণা দেওয়া হলো, কিন্তু কেউ নিচে নামেননি।

এর কিছুক্ষণ পর এক সময় আমাদের দরজায় কড়া পড়ে। বাবা এগিয়ে আসেন। দরজা খুলেই বাবা দেখতে পান একজন সেনা অফিসারকে।

তিনি বাবাকে জিজ্ঞাসা করেন নাম। বাবা বলেন, আমার নাম আবু নাসের মো. মনিরউজ্জামান। সেই অফিসার জানতে চাইলেন বিভাগের নাম। বাবা বললেন, পরিসংখ্যান।

বিজ্ঞাপন

আগে থেকেই সেনা কর্মকর্তাদের কাছে তালিকা ছিল কাকে কাকে তারা হত্যা করবে। বাবার পরিচয় পাওয়ার পর ওই সেনা অফিসার তালিকায় চোখ রাখলেন। মিলে গেছে নাম। ওই সেনা কর্মকর্তা বাবার হাতের ডানপাশ ধরলেন। এরপর জানতে চাইলেন বাড়িতে আর কোনো পুরুষ আছে কি না?

একে একে সেনাবাহিনী আমার চাচা অ্যাডভোকেট সামসুজ্জামান, ভাই আকরামুজ্জামন, আমাদের ফুফাতো ভাই সৈয়দ নাসিরুল ওয়াহাবকে বের করে নিয়ে যায়। সেই সময় আমাকেও নিয়ে যাওয়া হলো। তিনতলা থেকে আমাদের সবাইকে নিচতলায় নিয়ে যাওয়া হলো। ঊর্ধ্বতন একজন সেনা অফিসার বাবাকে মাটিতে বসার জন্য বললেন। বাবা কথা শুনলেন না। কথা না শোনায় সঙ্গে সঙ্গে বেয়নেট নিয়ে পায়ের অংশ অনেকখানি ফেড়ে ফেলা হলো। এরপর বাবাকে আমার চোখের সামনে কপালে গুলি করা হয়। বাবা মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। এরপর চাচাকে পরপর দুটো গুলি করে, ভাইকে তল পেটে গুলি করে ঘাতকেরা।

আমাদের বাসায় তাণ্ডব চালিয়ে এরপর মিলিটারি চলে যায় স্যার গুহ ঠাকুরতার বাসায়। গুহ ঠাকুরতার স্ত্রী বাসন্তী দরজা খুলে দেখতে পান সেনাবাহিনীর কয়েকজন দাঁড়িয়ে আছেন। গুহ ঠাকুরতাকে কানের নিচের অংশে গুলি করা হয়। এরপর মিলিটারিরা চলে যায়।

আমার মা তখনো জানতেন না এতকিছু ঘটে গেছে। মা বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। নিচে কী হচ্ছে মা তা দেখতে পাচ্ছেন না। কেবল গুলির শব্দ শুনছেন। একসময় অন্ধকারে ভেসে আসে একটা আর্তনাদ, ‘আমাকে কি একটু জল দেবে বাসন্তী?’

বিজ্ঞাপন

তখন মা এগিয়ে গিয়ে জানতে চান ‘আপনি কে?’ তখন তিনি বললেন, আমি নিচতলার গুহঠাকুরতা। আপনার বউ দিদিকে কে কি একটু ডেকে দিবেন?

মা নিচে এসে দেখেন, আমার বাবার লাশ পড়ে আছে।

আমার বয়স অল্প হওয়ায় ওই সময় একজন সেনা অফিসার আমাকে ছেড়ে দেন। ফলে আমি বেঁচে যাই। আমাকে  ছেড়ে দিয়ে মিলিটারিরা চলে যায় জগন্নাথ হলের দিকে। আর্মিরা জগন্নাথ হলের পূর্বদিকে আগুন ধরিয়ে দেয়। এরপর জগন্নাথ হলে চালানো হয় নির্মম-নির্বিচার গুলি। জগন্নাথ হলের এখানে বাবার লাশ নিয়ে আসা হয়। এছাড়া রাখা হয় অগণিত আরো লাশ।

লাশ টানার জন্য হলের কয়েকজন সাধারণ ছাত্রকে ব্যবহার করে আর্মিরা। লাশ টানা শেষে ওই ছাত্রদের লাইনে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়। আমাকে দ্বিতীয়বার ধরে আনার পর ওই লাইনে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। রাতে যে অফিসার আমাকে ছেড়ে দেন তিনি আমাকে দেখে চিনতে পারেন।

অন্য অফিসারদের কাছে জিজ্ঞাসা করেন, একে ধরে এনেছো কেন? এরপর আমাকে লাইন থেকে সরিয়ে নেওয়ার পরপরই ব্রাশফায়ার করা হয়। পুরো লাইনের সব মানুষ মারা যান, কেবল বেঁচে ছিলেন এক ছাত্র। সে সময় তার হাতে গুলি লাগে। এরপর জগন্নাথ হলে পড়ে থাকা লাশগুলো গণকবর দেওয়া হয় জগন্নাথ হলের মাঠে।

সারাবাংলা/একে

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন