বিজ্ঞাপন

দুবাইয়ে ৪৫৯ বাংলাদেশির সম্পত্তি অনুসন্ধানের নির্দেশ

January 15, 2023 | 2:15 pm

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে ৪৫৯ বাংলাদেশির সম্পত্তি থাকার বিষয়ে অনুসন্ধানের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ), জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগকে (সিআইডি) অনুসন্ধান করে ৩০ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। এ বিষয়ে পরবর্তী শুনানির জন্য আগামী ১৯ ফেব্রুয়ারি ‍দিন ধার্য করেছেন আদালত।

বিজ্ঞাপন

পাশাপাশি দুবাইয়ে বাংলাদেশির সম্পদ কেনা নিয়ে ওঠা অভিযোগ অনুসন্ধানে বিবাদীদের নিষ্ক্রিয়তা কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট। চার সপ্তাহের মধ্যে সংশ্লিষ্টদের রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।

রোববার (১৫ জানুয়ারি) বিদেশে অর্থপাচার সংক্রান্ত এক রিটের সম্পূরক আবেদনের শুনানি শেষে বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি খিজির হায়াতের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট এ আদেশ দেন।

আদালতে আবেদনের পক্ষে শুনানি আইনজীবী সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন ও সুবীর নন্দী দাস। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল একেএম আমিন ‍উদ্দিন মানিক ও আন্না খানম কলি।

বিজ্ঞাপন

আদেশের পর আইনজীবী সুবীর নন্দী দাস বলেন, ‘দুবাইয়ে ৪৫৯ বাংলাদেশির বাড়ি ও সম্পত্তির বিষয়ে অনুসন্ধান করার জন্য আমরা একটি সম্পূরক আবেদন করেছিলাম। ওই আবেদনের শুনানি করে শেষে আদালত দুদক, বিএফআইইউ, এনবিআর ও সিআইডিকে এ বিষয়ে অনুসন্ধান করে ৩০ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলেছেন। একই সঙ্গে এ বিষয়ে রুল জারি করেছে আদালত। এ ছাড়া দৈনিক বণিক বার্তা পত্রিকায় এ বিষয়ে প্রকাশিত সংবাদের বস্তুনিষ্ঠতার বিষয়ে ১৫ দিনের মধ্যে আদালতে হলফনামা আকারে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।’

আদেশের পর আইনজীবী সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন বলেন, ‘দুবাই, কানাডা ও আমেরিকায় বাংলাদেশি নাগরিকদের বাড়ি থাকার বিষয়টি এখন টক অব দ্যা কান্টি। বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা এবং চিকিৎসা বাবদ বাংলাদেশ থেকে বিদেশে টাকা নিয়ে যাওয়া যায়। বাড়ি কেনা বা সম্পত্তি কেনার জন্য কোনোভাবেই বাংলাদেশ থেকে টাকা বিদেশে নেওয়ার বিধান নাই। কেউ যদি বাড়ি কেনা বা সম্পত্তি কেনার জন্য টাকা বিদেশে নেয় তা সরাসরি অবৈধ হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আজ আমরা আদালতকে জানিয়েছি যে, বিদেশে বাড়ি কেনা বা অবৈধ সম্পত্তি থাকা বাংলাদেশিদের বিষয়ে মাত্র ৩০ ডলার খরচ করে তথ্য পাওয়া যায়। মাত্র ৩০ ডলার খরচ করে পাবলিক ডকুমেন্ট হিসেবে সন্দেহজনক যে কোন বাংলাদেশির বাড়ি আছে কিনা তা জানা যায়। ওইসব দেশে তথ্য ‍লুকানোর কোন সুযোগ নেই। কেউ যদি বাড়ির মালিক হন তাহলে নিয়ম অনুসরণ করে তথ্য চাইলে তা বের হয়ে আসবে।’

বিজ্ঞাপন

তবে কেউ যদি বাড়ি বা সম্পদ তার নিজের নামে না কেনে তার পরিবারের সদস্য বা আত্মীয় স্বজনের নামে কিনলেই সেই তথ্য খুঁজে বের করা কঠিন। এটা বড় একটা চ্যালেঞ্জ। আমরা আদালতকে জানিয়েছি, বিদেশে অবৈধ সম্পদ অবৈধ কেনা বা বাড়ি তৈরিকারীদের ধরার বিষয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থার যদি আগ্রহ থাকে তাহলে মাত্র ৩০ ডলার খরচ করে আবেদন করতে পারে। এরপর যাদের নাম আসবে তাদের ডেকে সম্পদের বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারে সরকারি সংস্থাগুলো।

আইনজীবী সুমন বলেন, ‘শুনানি শেষে আদালত ৪৫৯ জন ব্যক্তির দুবাইয়ে বাড়ি বা সম্পদ গড়ার বিষয়ে তথ্য জানতে চেয়েছেন। আমি মনে করি আদালতের আজকের সিদ্ধান্তটি একটি যুগান্তকারী আদেশ।’

এ বিষয়ে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল একেএম আমিন উদ্দিন মানিক বলেন, ‘গত ১০ জানুয়ারি দৈনিক বণিক বার্তা পত্রিকায় ‘দুবাইয়ে ৪৫৯ বাংলাদেশীর হাজার প্রপার্টি’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদন যুক্ত করে আদালতের দায়ের এক সম্পূরক আবেদনের শুনানি আজ অনুষ্ঠিত হয়েছে।’

যদিও এর আগে সুইস ব্যাংকসহ বিদেশে অর্থপাচার সংক্রান্ত বিষয়ে জারি করা একটি রুল বিচারাধীন রয়েছে। ওই রুলের সঙ্গে যুক্ত করতে গত সপ্তাহে সম্পূরক আবেদনটি করেন আইনজীবী।

বিজ্ঞাপন

ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল আরও বলেন, ‘শুনানি শেষে আদালত, দুবাইয়ে ৪৫৯ বাংলাদেশির সম্পদের বিষয়ে দুদক, বিএফআইইউ, এনবিআর ও সিআইডিকে অনুসন্ধানের নির্দেশ দিয়েছেন। অনুসন্ধান করে ৩০ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে। একই সঙ্গে দুবাইয়ে অবৈধভাবে অর্থপাচার করে কেউ যদি সম্পত্তি কিনে থাকে সেই বিষয়ে অনুসন্ধানে ব্যর্থতাকে কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন আদালত।’

পাশাপাাশি দৈনিক বণিক বার্তা পত্রিকাকে তাদের প্রতিবেদনের বস্তুনিষ্ঠতার বিষয়ে তথ্য প্রদান করতে বলেছেন আদালত। আগামী ১৯ ফেব্রুয়ারি এ বিষয়ে পরবর্তী শুনানির জন্য দিন ধার্য করা হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, ‘আজ শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে আদালতে বলা হয়েছে, যারা বৈধভাবে বিদেশে টাকা নিয়েছে তাদের যেন কোনোভাবেই হয়রানি করা না হয়। অনেকে বৈদেশিক মুদ্রা আনয়নের জন্য সেসব জায়গায় লিয়াজো অফিস খুলে থাকতে পারেন। তারা বৈধভাবে টাকা নিয়ে সেখানে ফ্ল্যাট বা বাড়িঘর করেছেন। আমরা আদালতে বলেছি, যারা অবৈধভাবে টাকা পাচার করেছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হোক। কিন্তু বৈধভাবে যারা টাকা নিয়েছে, তাদের যেন হয়রানি করা না হয়।’

এর আগে গত ১২ জানুয়ারি সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সুবীর নন্দী দাস বিদেশে অর্থ পাচার সংক্রান্ত রিটের সঙ্গে যুক্ত করতে একটি সম্পূরক আবেদন করেন।

তারও আগে আগে বিদেশি ব্যাংক, বিশেষ করে সুইস ব্যাংকে পাচার করা ‘বিপুল পরিমাণ’ অর্থ উদ্ধারে যথাযথ পদক্ষেপের নির্দেশনা চেয়ে ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টে জনস্বার্থে রিট করেছিলেন আইনজীবী সুবীর নন্দী দাস ও আব্দুল কাইয়ুম খান। সে রিটের প্রাথমিক শুনানির পর ওই বছর ২৮ ফেব্রুয়ারি রুলসহ আদেশ দেন হাইকোর্ট। পরে আরও কয়েক দফা শুনানি ও আদেশ হয় ওই রিটে। গত বছর ৩০ জানুয়ারি আদেশে আদালত সুইস ব্যাংকসহ অন্যান্য বিদেশি ব্যাংকে দেশের কারা অর্থ জমা রেখেছে বা পাচার করেছে, তা জানতে চান। ওই রিটের ধারাবাহিকতায় ৪৫৯ বাংলাদেশির সম্পদ কেনা নিয়ে ওঠা অভিযোগের অনুসন্ধানের নির্দেশনা চেয়ে আবেদন করেন আইনজীবী সুবীর।

‘দুবাইয়ে ৪৫৯ বাংলাদেশির হাজার প্রপার্টি’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদন সংযুক্ত করে এই আবেদন করা হয়।

ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রকাশ্যে-গোপনে বিপুল পরিমাণ মূলধন স্থানান্তরিত হচ্ছে দুবাইয়ে। এ অর্থ পুনর্বিনিয়োগে ফুলে ফেঁপে উঠছে দুবাইয়ের আর্থিক, ভূসম্পত্তি, আবাসনসহ (রিয়েল এস্টেট) বিভিন্ন খাত।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড ডিফেন্স স্টাডিজের (সি৪এডিএস) সংগৃহীত তথ্য বিশ্লেষণের ভিত্তিতে ইইউ ট্যাক্স অবজারভেটরি জানিয়েছে, বাংলাদেশে তথ্য গোপন করে দুবাইয়ে প্রপার্টি কিনেছেন ৪৫৯ বাংলাদেশি। ২০২০ সাল পর্যন্ত তাদের মালিকানায় সেখানে মোট ৯৭২টি প্রপার্টি ক্রয়ের তথ্য পাওয়া গেছে, কাগজে-কলমে যার মূল্য সাড়ে ৩১ কোটি ডলার। তবে প্রকৃতপক্ষে এসব সম্পত্তি কিনতে ক্রেতাদের ব্যয়ের পরিমাণ আরো অনেক বেশি হতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

দুবাইয়ে বসবাসকারীসহ বিভিন্ন সূত্রের অনানুষ্ঠানিকভাবে জানানো তথ্য অনুযায়ী, ইইউ ট্যাক্স অবজারভেটরির পরিসংখ্যানটি করা হয়েছে সি৪এডিএসের ২০২০ সালের তথ্য নিয়ে। এরপর গত দুই বছরে দুবাইয়ে বাংলাদেশিদের সম্পত্তি ক্রয়ের প্রবণতা আরও ব্যাপক মাত্রায় বেড়েছে। এ সময়ের মধ্যে বিপুল পরিমাণ সম্পত্তি কিনেছেন বাংলাদেশিরা, যার তথ্য তারা দেশে পুরোপুরি গোপন করেছেন।

বিভিন্ন মাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, দুবাইয়ে বাংলাদেশিদের গোপনে কেনা সম্পদের অর্থমূল্য এখন কম করে হলেও এক বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি। বৈশ্বিক অর্থনীতির করোনাকালীন বিপত্তির মধ্যেও দেশটির রিয়েল এস্টেট খাতের বিদেশি প্রপার্টি ক্রেতাদের মধ্যে বাংলাদেশিরা ছিল শীর্ষে।

স্থানীয় ভূমি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, করোনায় দুবাইয়ে বাংলাদেশি ধনীরাই সবচেয়ে বেশি সম্পদ কিনেছেন। এদিক থেকে নেদারল্যান্ডস, সুইজারল্যান্ড, চীন ও জার্মানির মতো দেশগুলোর বাসিন্দাদের পেছনে ফেলেছেন বাংলাদেশিরা।

দেশের বিত্তবানদের কাছে দীর্ঘদিন দুবাইয়ের আকর্ষণ ছিল নিছক পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় এ আকর্ষণ রূপ নিয়েছে প্রকাশ্য ও গোপন লগ্নির কেন্দ্র হিসেবে। আকর্ষণীয় মুনাফার খোঁজে রিয়েল এস্টেট ছাড়াও অন্যান্য ব্যবসায় নাম লেখাচ্ছেন তারা। দেশের অনেক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানই এখন দুবাইকে বেছে নিয়েছে ব্যবসায়িক কার্যক্রমের কেন্দ্র হিসেবে।

২০২০ সালে করোনার মধ্যেই দেশের নির্মাণ খাতের ঠিকাদারির সঙ্গে যুক্ত একজন ব্যবসায়ী দুবাই চলে যান। এর পর থেকে তিনি সেখানেই বসবাস করছেন। দেশের ব্যবসা থেকে উপার্জিত মুনাফা প্রতিনিয়ত দুবাইয়ে স্থানান্তর করছেন তিনি। এরই মধ্যে তিনি দুবাইয়ের আবাসন ও নির্মাণ খাতে বড় ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন।

সারাবাংলা/কেআইএফ/ইআ

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন