বিজ্ঞাপন

ইসিতে মতবিনিময়— অংশগ্রহণমূলক ও সুষ্ঠু নির্বাচন চান সাংবাদিকরা

September 13, 2023 | 11:03 pm

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: নির্বাচন কমিশন (ইসি) আয়োজিত মতবিনিময়ে অন্য শ্রেণিপেশার প্রতিনিধিদের পাশপাশি অংশ নিয়েছেন সাংবাদিকরাও। মতবিনিময়ে মাঠপর্যায়ের প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন ‘বির্তকিত’ ভূমিকা, রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন ও পর্যবেক্ষক ইস্যুতে ইসির কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করেছেন তারা। বলেছেন, যেকোনো মূল্যে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অংশগ্রণমূলক এবং অবাধ ও সুষ্ঠু করতে হবে।

বিজ্ঞাপন

বুধবার (১৩ সেপ্টেম্বর) নির্বাচন ভবনের সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত ‘দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন: প্রত্যাশা ও বাস্তবতা’ শীর্ষক বৈঠকে অংশ নিয়ে তারা এসব কথা বলেন। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে নাগরিক সমাজ, সাংবাদিক, অধ্যাপক ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞদের নিয়ে ইসি এই মতবিনিময় সভার আয়োজন করে।

সিনিয়র সাংবাদিক ও প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক সোহরাব হাসান বলেন, আমরা একতরফা ও জবরস্তিমূলক নির্বাচন চাই না। এমন নির্বাচন চাই না, যে নির্বাচনে ভোটাররা ভোট দিতে পারবেন না, যেখানে ভোটারদের নিরাপত্তা থাকবে না। ইসিকে এমন নির্বাচনের পরিবেশ করতে হবে যেন সব ভোটর নির্ভয়ে ভোট দিতে পারে। তা না হলে প্রিজাইডিং অফিসারের মতো ইসিকে তল্পিতল্পাসহ ছেড়ে দিয়ে বলতে হবে, আমরা পারলাম না। কারণ নির্বাচনের পরিবেশ নেই।

আরও পড়ুন- ‘জামালপুরের মতো ডিসিদের বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত নিতে হবে’

বিজ্ঞাপন

তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশনকে ১২ কোটি ভোটারের নিরাপত্তা দিতে হবে। নির্বচনে ভোটের এবং ভোটারের নিরাপত্তা দিতে হবে। ২০০১ সালে নির্বাচন নিয়ে সবচেয়ে বেশি সমালোচনা হয়েছে যে কারণে সেটা হলো— মানুষ ভোট দিতে পারলেও ভোটের পর ভোটারের নিরাপত্তা ছিল না। বিশেষ করে সংখ্যালঘু ও বিরোধী দলের ভোটারের ওপর নির্যাতন হয়েছে। সুতরা নির্বাচনে ভোট ও ভোটারের নিরাপত্তা দিতে হবে।

এর আগের জাতীয় সংসদ নির্বাচনগুলোর প্রসঙ্গ টানেন সোহরাব হোসেন। এসব নির্বাচনে দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি কখনো ৩৭ শতাংশ, কখনো ৩৩ শতাংশ ভোট পেয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি। বলেন, ফলে আপনারা যদি ৩৩ শতাংশ ভোটারকে বাদ দিয়ে নির্বাচন করেন, সে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না। সুতরাং নির্বাচন কমিশনকে সবাইকে নিয়ে নির্বাচন করতে হবে।

নির্বাচনে বর্তমান জেলা প্রশাসকদের রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে রাখার বিরোধিতা করন সিনিয়র এই সাংবাদিক। বলেন, বর্তমানে ৬৪ জেলায় কর্মরত এমন একজন ডিসি-এসপি পাওয়া যাবে না, যিনি ক্ষমতাসীন দলের আদেশ অমান্য করবেন। তিনি কি অপারগতা প্রকাশ করবেন? ফলে নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করতে হলে বর্তমানে যারা ডিসি আছেন তাদের কাউকে রিটার্নিং কর্মকর্তা রাখা যাবে না। আপনারা যদি এর বিকল্প বের করতে পারেন, তাহলে নির্বাচন জনগণের কাছে আস্থার জায়গা হতে পারে। আমরা ওই অবস্থায় যেতে না পারলে দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব না। ১৯৯১ সালে এরশাদের অর্পিত সংবিধান রেখেও যদি সুষ্ঠু নির্বাচন হয়, তাহলে এখনো এমন কোনো পদ্ধতি বের করতে হবে যেখানে বর্তমান সংবিধানের মধ্যে থেকেও সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব।

বিজ্ঞাপন

আরও পড়ুন- ‘বিদেশি রাষ্ট্রগুলোকে আমরাই ডেকে এনেছি’

জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিন বলেন, বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন নির্বাচন কমিশনের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। বলা হচ্ছে নির্বাচন কমিশনের প্রতি আস্থার সংকট রয়েছে। তবে আমি বলব, এই কমিশনের অধীনে বেশকিছু নির্বাচন এরই মধ্যে হয়েছে। কমিশন এসব নির্বাচনে কিছুটা হলেও পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে। এতে করে কিছুটা আস্থার সংকট কেটেছে।

ফরিদা ইয়াসমিন বলেন, ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে ভোটারের উপস্থিতি খুবই কম ছিল। এ ছাড়াও একজন প্রার্থীকে ভয়ভীতি দেখানো হয়েছে, মারধর করা হয়েছে। নির্বাচনে অংশগ্রহণ করানো নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব না। এটি রাজনৈতিক দল ও সরকারের দায়িত্ব। আর নির্বাচন কমিশনের মূল দায়িত্ব হলো জনগণকে আস্থার সংকট থেকে ভোটের মাঠে নিয়ে আসা।

দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব না— এ কথায় বিশ্বাস করেন না বলে জানান প্রেসক্লাবের সভাপতি। বলেন, আমি মনে করি নির্বাচন কমিশন চাইলে দলীয় সরকারের অধীনেও সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব। ইসির যদি সেই রকম কমিটমেন্ট থাকে, সদিচ্ছা থাকে, মেরুদণ্ড থাকে, তাহলে তাদের পক্ষেও সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব।

বিজ্ঞাপন

আরও পড়ুন- সরকারের সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রতিশ্রুতিতে আস্থা রাখতে চাই: সিইসি

জাতীয় প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ও ভোরের কাগজের সম্পাদক শ্যামল দত্ত বলেন, বর্তমান বাস্তবতা হলো বাংলাদেশের নির্বাচনব্যবস্থা বিশ্বাসহীনতায় ভুগছে। এর দায়ভার আমাদের না। দীর্ঘ সময় ধরে এটা আমরা এই জায়গায় নিয়ে এসেছি। নির্বাচন কমিশন, রাজনৈতিক দল ও সরকারের মধ্যে একটার সঙ্গে আরেকটার সংযোগ থাকার কথা থাকলেও বাস্তবে সেখানে বড় ধরনের ফারাক রয়েছে। এই ফারাকগুলো কীভাবে জোড়া লাগবে, তার কোনো নির্দেশনা আমরা দেখছি না। আবার একটি ভালো নির্বাচন হলেও যে রাজনৈতিক সংকটের সমাধান হয়ে যাবে, তা মনে করছি না। তবে একটি ভালো নির্বাচন এসব সমস্যার সমাধানের পথ হতে পারে।

বিদেশিদের সমালোচনা করে শ্যামল দত্ত বলেন, একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন দূতাবাসের লোকজন কীভাবে এসে আলোচনা করতে পারেন? আপনাদের সঙ্গে তারা দেখা করার অনুমতি পায় কীভাবে? বাংলাদেশের রাষ্ট্রদৃতরা কি বিদেশে গিয়ে সে দেশের নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে বৈঠক করতে পারবেন? আমাদের কিছু সুশীল সমাজের প্রতিনিধি প্রতিদিন মার্কিন দূতাবাসে গিয়ে বসে থাকেন। তাদের নানা উপদেশ দিয়ে আসেন। রাতে ডিনার, সকালে ব্রেকফাষ্ট করেন। ওদের টেনে আনা হচ্ছে। এর ফল ভালো হয় না।

নির্বাচন ঘিরে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিরাপত্তা দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে এই সাংবাদিক নেতা বলেন, বাংলাদেশের সব নির্বাচনে ভিকটিম হয় সংখ্যালঘুরা। এই বিষয়ে নির্বাচন কমিশনকে দায়িত্ব পালন করতে হবে। ২০১৪ সালের নির্বাচন বলেন আর ২০১৮ সালের নির্বাচন বলেন, বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নারী, সংখ্যালঘু গোষ্ঠী ভিকটিম হয়েছে। এই বিষয়গুলো বিবেচনায় রাখতে হবে।

জাতীয় প্রেসক্লাবের সিনিয়র সহসভাপতি রেজোয়ানুর হক রাজা বলেন, ঢাকা-১৭ আসনে কেন্দ্রের বাইরে পাঠিয়ে দেয়ার পর একজন প্রার্থী আক্রান্ত হলেন। এ বিষয়ে পুলিশ-প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশন কী ব্যবস্থা নিয়েছে, তা এখনো পরিষ্কার না। সেখানে ইসির ক্ষমতা প্রয়োগের ঘাটতি রয়েছে।

তিনি বলেন, জামালপুরের জেলা প্রশাসক ও বিভিন্ন থানার ওসিদের বক্তব্যের বিষয়ে বলা হয়েছে সরকার ব্যবস্থা নিয়েছে। কিন্তু আমার কথা হলো— সরকার ব্যবস্থা নিয়েছে কিংবা ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দিয়েছেন, এটি যথেষ্ট না। মানুষ দেখতে চায় নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা কী। আমরা প্রত্যাশা হলো— ডিসি, এসপি ও ওসিরা যখন এ ধরনের কথা বলেন, তখন ইসির পক্ষ থেকে প্রশাসনকে স্পষ্ট বার্তা দিতে হবে যেন কেউ এ ধরনের বক্তব্য দিতে না পারেন। ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিপর্যয় হয়েছিল প্রশাসন ও পুলিশের অতি উৎসাহী কিছু কর্মকর্তাদের কারণে। এটা আমরা সবাই জানি। সুতরাং প্রশাসন ও পুলিশকে এ ব্যাপারে কমিশনের পক্ষ থেকে বার্তা দেয়া উচিত।

রাজা বলেন, নির্বাচন কমিশন কী চায়, সেটি অনেকটা বোঝা যায় তাদের আচরণ থেকে। নির্বাচন পর্যবেক্ষক মনোনয়ন, এমনকি নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন দেওয়ার ক্ষেত্রেও নির্বাচন কমিশনের মনোভাব, ইচ্ছা-অনিচ্ছা অনেকটা প্রকাশিত হয়েছে। নির্বাচন পর্যবেক্ষকের যে নতুন তালিকা দিয়েছেন, সেটি দেখে আমি একজন সংবাদকর্মী হিসেবে খুবই হতাশ হয়েছি। এমন নামও তালিকায় দেখলাম যার সঙ্গে নির্বাচনের কোনো সম্পর্ক আমি খুঁজে পাইনি। দারিদ্র্য বিমোচন সংস্থা— যে সংগঠনটির কাজ দারিদ্র্য নিয়ে কাজ করা, তারা কীভাবে নির্বাচন পর্যবেক্ষক হলো?

সম্প্রতি যে দুটি রাজনৈতিক দলকে নিবন্ধন দেওয়া হয়েছে সেগুলো নিয়ে প্রশ্ন তুলে এই সাংবাদিক বলেন, দুটি রাজনৈতিক দলকে আপনারা নিবন্ধন দিয়েছেন। এটা নিয়ে কী ধরনের সমালোচনা হয়েছে, সেটি আপনারাও জানেন। আপনাদের নির্বাচন পর্যবেক্ষকের তালিকা এবং রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনের তালিকা দেখে জাতি লজ্জিত। এই লজ্জা থেকে জাতিকে রক্ষা করেন, এটা আমার প্রার্থনা।

সিনিয়র সাংবাদিক মাসুদ কামাল বলেন, আসলে নির্বাচন কমিশনের কাজটা কী? নির্বাচন কমিশনের কাজটা হলো দেশের মানুষকে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্যে ঢোকানো নাকি যে সিস্টেমটা তৈরি করা হয়েছে সেটাকে এগিয়ে নেয়া? আমরা যদি ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচন ধরি, আমরা দেখেছি— দুটি নির্বাচনেই এমন ব্যবস্থা তৈরি করা হয়েছে যে ব্যবস্থার মধ্যে থাকলে ক্ষমতাসীন দলকে ক্ষমতা থেকে সরাানোর কোনো উপায় নেই।

মাসুদ কামাল আরও বলেন, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের দুই নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন দল মোটামুটি একটা মজার ব্যবস্থা করেছে, যে মজার মাধ্যমে তারা নির্বাচিত হয়ে যাবে। এখন সেই মজাকে আরও কত স্মুথ করা যায়, সেই দায়িত্ব নিয়ে কি নির্বাচন কমিশন কাজ শুরু করেছে? নাকি জনগণের গণতান্ত্রিক যে প্রত্যাশা রয়েছে, সেই প্রত্যাশাকে কীভাবে বাস্তবায়ন করা যায় সেদিকে নজর দেবেন? নির্বাচন কমিশন কি জনগণের অংশ, নাকি সরকারের অংশ, নাকি সরকারি দলের অংশ— এসব মাথায় রাখতে হবে।

নির্বাচন কমিশন আয়োজিত সভায় সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত, স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ, সাবেক সচিব আবু আলম মো. শহীদ খান, সাবেক রাষ্ট্রদূত মো. হুমায়ূন কবীর, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক আল মাসুদ হাসানুজ্জামান, জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষণ পরিষদের চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহসহ অন্যরা উপস্থিত ছিলেন।

সাংবাদিকদের মধ্যে আরও উপস্থিত ছিলেন ইনডিপেন্ডেন্ট টেলিভিশনের প্রধান বার্তা সম্পাদক আশিষ সৈকত, আরটিভির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ আশিক রহমান, নাগরিক টিভির হেড অব নিউজ দীপ আজাদ, সিনিয়র সাংবাদিক অজয় দাস গুপ্ত, সময় টিভির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আহমেদ জুবায়ের, গাজী টিভির হেড অব নিউজ ইকবাল করিম নিশান, আজকের পত্রিকার জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক বিভুরঞ্জন সরকার প্রমুখ।

মতবিনিময় সভায় প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, দলীয় সরকারের অধীনেই অবাধ ও ‍সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে সরকারের দেওয়া প্রতিশ্রুতির ওপর নির্ভর করতে চান তারা। তিনি বলেন, ‘সরকার যেহেতু তার জায়গা থেকে এটি অনুধাবন করে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, সরকার তার প্রতিশ্রুত রক্ষা করবেন, আমি আশ্বস্ত বোধ করছি।’

সারাবাংলা/জিএস/টিআর

Tags: , , , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন