বিজ্ঞাপন

শ্রমবাজার-বৈষম্যে ঝুঁকি বাড়াবে এআই, নিরাপদ প্রয়োগে কী করছে বিশ্ব

January 16, 2024 | 10:02 am

তরিকুর রহমান সজীব

দিন দিন গবেষণার মাধ্যমে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, সংক্ষেপে এআই) হয়ে উঠছে আরও বেশি বুদ্ধিমান। এই প্রযুক্তির প্রয়োগে মানুষের নিত্যদিনের কাজ হয়ে উঠছে সহজ। ঠিক এই মুহূর্তে বিশ্ব এমন একটি জায়গায় দাঁড়িয়ে রয়েছে, যেখানে এআই দিয়েই কিছু কিছু কাজ করে ফেলা সম্ভব হচ্ছে, যেগুলো করার জন্য এতদিন মানুষের প্রয়োজন ছিল আবশ্যক। ফলে এআই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মানুষের চাকরির জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে কি না, সেই প্রশ্নও দীর্ঘ দিনের।

বিজ্ঞাপন

এরকম একটি সময়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) নতুন এক বিশ্লেষণ বলছে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআইয়ের কারণে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত চাকরি হুমকির মুখে পড়বে। অর্থাৎ মানুষ যেসব কাজ করে থাকে, তার ৪০ শতাংশ পর্যন্ত এআইয়ের দখলে চলে যেতে পারে। আর ক্রমেই এআইয়ের কারণে মানুষে মানুষে বৈষম্যও বাড়বে।

আইএমএফের এই হিসাব অবশ্য উন্নত বিশ্বের জন্য। আন্তর্জাতিক সংস্থাটি মনে করছে, নিম্ন আয়ের বা অনুন্নত দেশগুলোতে এআইয়ের প্রভাব পড়বে কিছুটা কম। সে ক্ষেত্রেও ২৬ শতাংশ পর্যন্ত চাকরি চলে যেতে পারে এআইয়ের দখলে। ফলে এখনই এআই নিয়ে নতুন করে ভাবার তাগিদ দিচ্ছে সংস্থাটি।

আইএমএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ক্রিস্টালিকা জর্জিভা বলেন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বৈষম্য পরিস্থিতিতে আরও প্রকট করে তুলবে এআই। নীতিনির্ধারক যারা রয়েছেন, তাদের এখনই সমস্যাজনক এই প্রবণতাটি গুরুত্ব সহকারে আমলে নেওয়া উচিত, যেন এই প্রযুক্তি ঘিরে সবখানে যে দুশ্চিন্তা ছড়িয়ে পড়েছে তাকে আর উসকে দেওয়া না হয়।

বিজ্ঞাপন

বিভিন্ন খাতেই এআইয়ের প্রসার এর লাভক্ষতির হিসাবকে আরও সামনের দিকে নিয়ে আসছে। আইএমএফ বলছে, উন্নত অর্থনীতির দেশগুলোতে এআই চাকরির বাজারের বড় একটি অংশকেই প্রভাবিত করবে। এর পরিমাণ হবে ৬০ শতাংশ।

আইএমএফের বিশ্লেষণ বলছে, এর অর্ধেক ক্ষেত্রেই এআইয়ের অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে কর্মীরা উপকৃত হবেন। তাদের উৎপাদনশীলতা বাড়বে। তবে বাকি অর্ধেক ক্ষেত্রেই মূল কাজগুলোই এআই করে ফেলতে সক্ষম হবে, যেগুলো এতদিন মানুষকেই করতে হতো। এসব কাজে নিয়োজিত মানুষদের চাহিদা তখন কমে যাবে, তাদের পারিশ্রমিক কমে যাবে। এমনকি তাদের চাকরিতেই আর প্রয়োজন নাও হতে পারে।

আইএমএফের নতুন এই বিশ্লেষণকে উড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই। কেননা, এর আগে সদ্য বিদায়ী বছরেই গোল্ডম্যান স্যাকস তাদের এক প্রতিবেদনে বলছিল, বিশ্বব্যাপী প্রায় ৩০ কোটি পূর্ণকালীন চাকরিরত কর্মীকে এআই দিয়ে প্রতিস্থাপন করা যেতে পারে। এআইয়ের কল্যাণে উৎপাদনশীলতা বেড়ে যাওয়ার নতুন নতুন কিছু কাজের খাত তৈরি হবে বলেও অবশ্য উল্লেখ করা হয় সেই প্রতিবেদনে।

বিজ্ঞাপন

আইএমএফ মনে করছে, এআইয়ের অন্তর্ভুক্তির পর উচ্চ বেতনধারী ও অল্প বয়সী কর্মীদের মধ্যে মজুরি বাড়ানোর হারের ক্ষেত্রে বৈষম্য তৈরি হতে পারে। এ ক্ষেত্রে যাদের পারিশ্রমিক কম ও যারা বয়স্ক, তারা ক্রমেই পিছিয়ে পড়তে পারেন। এই বিষয়ে আগে থেকেই গ্রহণযোগ্য নীতি প্রণয়নের আহ্বান জানাচ্ছে আইএমএফ।

জর্জিভা বলেন, সরকারগুলোকে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কার্যক্রম আরও জোরদার করতে হবে। যেসব শ্রমিক হুমকির মধ্যে পড়বেন, আরও নতুন নতুন বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের কর্মোপেযোগী করে তোলার ব্যবস্থাও রাষ্ট্রকেই করতে হবে। এটি করতে পারলে তখনই কেবল আমরা এআই যুগে যাত্রার সময়টিকে সবার জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক করে তুলতে পারব। এর মাধ্যমে জীবন ও জীবিকার সুরক্ষা দেওয়া সম্ভব হবে, বৈষম্যও কমানো সম্ভব হবে।

কেবল কর্মীদের মধ্যে নয়, এআই সার্বিকভাবে দেশের সঙ্গে দেশেরও বৈষম্য তৈরি করতে পারে বলে আভাস আইএমএফের। জর্জিভা বলেন, অনেক দেশেই এমন অবকাঠামো বা দক্ষ জনবল নেই বা থাকবে না, যার মাধ্যমে এআইয়ের সুবিধাগুলো কাজে লাগানো সম্ভব হবে। সেক্ষেত্রে উন্নত দেশগুলো এআই ব্যবহার করে প্রযুক্তিসহ সব দিক থেকে অনেক এগিয়ে যাবে। তাদের উৎপাদনশীলতাও দিন দিন বাড়বে।

অন্যদিকে যেসব দেশ এআইয়ের সুবিধা নিতে পারবে না, তারা আরও পিছিয়ে পড়বে; ফলে প্রযুক্তির কারণে এবং প্রযুক্তিগত দিক থেকে বিভিন্ন দেশের মধ্যে বৈষম্য বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি আরও বাড়ছেই— বলেন আইএমএফের এমডি জর্জিভা।

বিজ্ঞাপন

সার্বিকভাবে এআই সারাবিশ্বের জন্যই এই মুহূর্তের অন্যতম আলোচিত বিষয়ে পরিণত হয়েছে। প্রযুক্তির অগ্রগামিতার যে স্বাভাবিকতা, তার কারণেই যত ঝুঁকিই থাকুক না কেন, এআইকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। ক্রমেই এটি বৈশ্বিকভাবেই মানুষের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়বে। শুধু তাই নয়, এআই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রসার অন্য সব প্রযুক্তির তুলনায় অনেক বেশি দ্রুতও হবে।

যে চ্যাটজিপিটি দিয়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সবার হাতে হাতে পৌঁছে গেছে সেই চ্যাটজিপিটির নির্মাতা ওপেনএআই-এর প্রধান নির্বাহী স্যাম অল্টম্যানও একই কথা বলছেন। মাইক্রোসফটের সহপ্রতিষ্ঠাতা বিল গেটসের সঙ্গে এক পডকাস্টে অতিথি হয়ে এসেছে অল্টম্যান বলেন, এর আগেও আমরা প্রযুক্তিগত নানা ধরনের বৈপ্লবিক যুগের উপস্থিতি দেখেছি। প্রতিটি ধাপই ছিল আগের প্রযুক্তির চেয়ে দ্রুত। এআই এদের সবাইকে ছাড়িয়ে যাবে। এর গতি হবে অনেক বেশি। আমার কাছে এই বিষয়টি কিছুটা হলেও ভয়ের কারণ যে এআইয়ের সঙ্গে মানিয়ে নিতে আমাদের পরিপার্শ্বকে অনেক বেশি দ্রুতগতির হতে হবে। এআইয়ের কারণে শ্রমবাজারও ব্যাপকভাবে বদলে যাবে।

এআইয়ের প্রভাব হবে বৈশ্বিক। ঠিক সে কারণেই বৈশ্বিকভাবেই এআই নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি সংস্থার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছেন অল্টম্যান। তিনি বলেন, সমাজ-রাষ্ট্র তো বটেই, এআই ভূরাজনৈতিক ভারসাম্যের ওপরও প্রভাব ফেলবে। ফলে বেশ্বিক একটি সংস্থা এখন সময়ের দাবি যারা এআইয়ের মতো ব্যাপক ক্ষমতাধর একটি সিস্টেমকে দেখভালের মধ্যে রাখবে।

অল্টম্যানের এমন ভাবনার পথে অন্যরাও ভাবছে না, তেমনটি নয়। বরং আইএমএফের নতুন বিশ্লেষণটি এমন একটি সময়ে প্রকাশ পেয়েছে, যখন বিশ্বনেতারা সুইজারল্যান্ডের দাভোসে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের বার্ষিক সভায় মিলিত হয়েছেন। বিভাজিত বিশ্বে নিরাপত্তা ও সহযোগিতা নিশ্চিত করা এবং জলবায়ু, প্রকৃতি ও জ্বালানি নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি কৌশল প্রণয়ন এবারের আসরের অন্যতম আলোচিত বিষয়। বাকি দুটি বিষয়ই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে সম্পর্কিত— প্রথমটি অর্থনীতি ও সমাজের চালিকাশক্তি হিসেবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, দ্বিতীয়টি নতুন যুগে কর্মসংস্থান ও প্রবৃদ্ধিতে ঊর্ধ্বগতি।

চ্যাটজিপিটিসহ কম্পিউটারনির্ভর বিভিন্ন এআই টুলসের বহুল প্রসার এবং এআই-নির্ভর আরও অনেক প্রযুক্তি নিয়ে ব্যাপকভিত্তিতে গবেষণার কারণেই আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক এই ফোরামেও এআই উঠে এসেছে অন্যতম আলোচ্য বিষয় হিসেবে। সেখান থেকে বিশ্বনেতারা এআই নিয়ে সর্বসম্মতভাবে কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার চেষ্টাই করবেন বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

এআই নিয়ন্ত্রণে আইন প্রণয়নের দিক থেকে এগিয়ে রয়েছে চীন। অনেক আগেই তারা এআই নিয়ে বিধিমালা প্রণয়ন করেছে। এআইয়ের জন্য কোন ধরনের অ্যালগরিদম ব্যবহার ও প্রয়োগ করা যাবে, সেই বিষয়গুলোতে জোর দেওয়া হয়েছে চীনের এই বিধানে। অন্যদিকে গত অক্টোবরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন একটি নির্বাহী আদেশ দিয়েছেন। এই আদেশের বলে এআই ব্যবহার করে যারা যা কিছুই তৈরি করুক না কেন, তার নিরাপত্তাসংশ্লিষ্ট ফলাফল মার্কিন সরকারকে জানাতে হবে।

এ ছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়ন অনেক আগেই এআই ব্যবহার নিয়ে পূর্ণাঙ্গ একটি আইন প্রণয়ন করেছে, যেটি এআই পরিচালনার ক্ষেত্রে বিশ্বের প্রথম কোনো পূর্ণাঙ্গ আইন। তবে আইনটি এখনো সম্পূর্ণরূপে গৃহীত হয়নি। তবে গত মাসে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট ও কাউন্সিল সাময়িকভাবে সম্মত হয়েছে— এই আইনের আলোকে মৌলিক অধিকার, গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও টেকসই পরিবেশ নিশ্চিত করার মতো বিষয়গুলোকে উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ এআই থেকে সুরক্ষিত রাখতে হবে।

অন্যদিকে গত নভেম্বরেই যুক্তরাজ্যে এআই সেফটি সামিট নামে দুই দিনব্যাপী একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন আয়োজন করে। এআই নিয়ে এমন আন্তর্জাতিক সম্মেলনও এটিই ছিল প্রথম। এআইয়ের ঝুঁকি ও করণীয়, এআইয়ের ঝুঁকি নিরসনে যৌথ উদ্যোগ, এআইয়ের নিরাপত্তা নিয়ে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ইত্যাদি ছিল এই সম্মেলনের আলোচ্য বিষয়। সম্মেলনে অংশ নেওয়া ২৮টি দেশ ‘ব্লেচলি ডিক্লারেশন’ শীর্ষক একটি ঘোষণাপত্রে সই করে যেখানে এআইয়ের ঝুঁকি ও নিরাপত্তাসহ সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোকে নিয়ে একযোগে কাজ করার বিষয়ে সবাই একমত হয়েছে।

এআই নিয়ে আইএমএফের বিশ্লেষণ কতটুকু প্রযোজ্য হবে, তা সময়ই বলে দেবে। তবে অল্টম্যানের ভাবনা অনুযায়ী এআই নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন দেশে আরও বিস্তারিত আইন প্রণয়ন এবং বৈশ্বিক একটি সংস্থা গঠন হতে হয়তো খুব বেশি সময় অপেক্ষা করতে হবে না।

সূত্র: বিবিসি, মিন্ট, আল জাজিরা, রয়টার্স, ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম

সারাবাংলা/টিআর

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন