বিজ্ঞাপন

সিজারিয়ান অস্ত্রোপচার করাতে এসে রোগীর মৃত্যু কার ভুলে?

March 21, 2024 | 10:20 am

সৈকত ভৌমিক, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: রাজধানীর কল্যাণপুরে ইবনে সিনা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে সি-সেকশন বা সিজারিয়ান অস্ত্রোপচারের ২৪ ঘণ্টা পরও রক্তক্ষরণ বন্ধ না হয়ে এক প্রসূতির মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। ওই প্রসূতির স্বজনদের অভিযোগ, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অস্ত্রোপচারের পর একপর্যায়ে প্রসূতির রক্তক্ষরণ বন্ধ হয়েছে বলে জানালেও প্রকৃতপক্ষে রক্তক্ষরণ বন্ধ হয়নি। পরে রোগীর জরায়ু কাজ করছে না বলেই রক্তক্ষরণ বন্ধ হচ্ছে না দাবি করে হাসপাতাল থেকে জরায়ু কেটে ফেলার জন্য অস্ত্রোপচারের কথা জানানো হয়। একপর্যায়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, ‘সিভিয়ার হার্ট অ্যাটাক’ হয়ে ওই প্রসূতির মৃত্যু হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

এ ঘটনায় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে ইবনে সিনা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। তবে সিজারিয়ান অস্ত্রোপচার যে চিকিৎসকের অধীনে হয়েছিল তিনি এ ঘটনায় কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও বলছে, তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন পাওয়ার পরই তারা মন্তব্য করবে।

গত সোমবার (১৮ মার্চ) সকাল ৯টা ৯ মিনিটে রাজধানীর কল্যাণপুর ইবনে সিনা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে ভর্তি করা হয় ওই প্রসূতি পলি সাহাকে। ডা. শারমিন মাহমুদের অধীনে দুপুর সোয়া ২টার দিকে তার সিজারিয়ান অস্ত্রোপচার করা হয়। পরদিন মঙ্গলবার (১৯ মার্চ) বিকেল ৪টার দিকে পলি সাহাকে মৃত ঘোষণা করা হয়। তার মৃত্যু সনদে মৃত্যুর একটি কারণ বলা হয়েছে প্রসব পরবর্তী রক্তক্ষরণ। আরেকটি কারণ বলা হয়েছে নন-এসটি ইলিভেটেড মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কসন, যেটি এক ধরনের হার্ট অ্যাটাক।

পলি সাহার স্বামী আশীষ রয় সারাবাংলাকে বলেন, ‘চিকিৎসকরা বলছিল রক্তক্ষরণ বন্ধ হয়ে গেছে। অথচ আমার স্ত্রী বারবার রক্তক্ষরণের কথা বলেছিল। প্রায় ২৪ ঘণ্টা ধরে তার রক্তক্ষরণ হয়। মাঝে এক ব্যাগ রক্তও দেওয়া হয়। পরে আবার রক্তক্ষরণ কেন হচ্ছে, তা জানতে অস্ত্রোপচার করে জরায়ু কেটে ফেলার কথা বলে। শেষ পর্যন্ত সেই রক্তক্ষরণের কারণে সে মারা গেছে বলে জানান চিকিৎসকরা। কার ভুলে তাহলে আমার স্ত্রীর মৃত্যু হলো?’

বিজ্ঞাপন

আশীষ রয় জানান, সোমবার দুপুরে ডা. শারমিন মাহমুদ প্রসূতি পলি সাহার সিজারিয়ান অস্ত্রোপচার করেন। এরপর জানান, প্রসূতি ও নবজাতক উভয়েই ভালো আছে। বিকেল ৫টার দিকে পলিকে পাঠানো হয় পোস্ট অপারেটিভ কেয়ারে। তখন কর্তব্যরত চিকিৎসক জানান, কিছু রক্তক্ষরণ হলেও রোগী ভালো আছে। পলির অস্ত্রোপচারে নেতৃত্ব দেওয়া ডা. শারমিন সন্ধ্যা ৭টার দিকে আবার প্রসূতিকে দেখে জানান, তার জন্য এক ব্যাগ রক্ত লাগবে।

পলির স্বামী আশীষ বলেন, রাত ৯টার দিকে আমি আবার আমার স্ত্রীর অবস্থা জানতে চাই। তারা জানায়, রক্তক্ষরণ আগের চেয়ে কমেছে। এটা নিয়ে শঙ্কা নেই। তবে রক্তচাপ কিছুটা কম, যা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। ঘণ্টাখানেক পরও পোস্ট অপারেটিভ কেয়ার থেকে একই কথা জানায় আমাকে। কিন্তু তারও ঘণ্টাখানেক পর পলি আমাকে জানায়, ওর রক্তক্ষরণ বন্ধ হচ্ছে না এবং অস্থির লাগছে। এ কথা বললে তখনো পোস্ট অপারেটিভ কেয়ারের চিকিৎসক বলেন, রক্তক্ষরণ কমে গেছে। রোগীর রক্তচাপ নিয়ে তারা চিন্তিত।

আশীষ রয়ের ভাষ্য, সোমবার ১টা পর্যন্ত পলি তাকে বারবারই বলেছেন রক্তক্ষরণ বন্ধ না হওয়া ও অস্থিরতার কথা। এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে কর্তব্যরত চিকিৎসকরাও আগের মতোই উত্তর দেন তাকে। এরপর রাতে আর তাকে প্রসূতির সঙ্গে দেখা করতে দেওয়া হয়নি। পরে ভোর ৪টার দিকে তাকে জানানো হয়, রোগীর শারীরিক অবস্থার অবনতি হচ্ছে।

বিজ্ঞাপন

আশীষ রয় বলেন, ডা. শারমিন আমাকে ফোন দিয়ে বলেন, রোগীর অবস্থা ধীরে ধীরে খারাপ হচ্ছে। তাই তাকে আইসিইউতে নিতে হবে। ভোর ৬টার দিকে তিনি হাসপাতালে এলে পলিকে আইসিইউতে নিয়ে যাওয়া হয়। ১০ মিনিট পরই ডা. শারমিন আবার আমাকে বলেন, ইন্টার্নাল কোথাও ব্লিডিং হচ্ছে কি না, তা দেখার জন্য পলিকে আবার অপারেশন করতে হবে। তখন পলির অবস্থা খুব খারাপ।

তিনি আরও বলেন, ওই সময় সমস্যার বিষয়ে জানতে চাইলে চিকিৎসকরা বলেন, পলির জরায়ু বের করে তারা দেখবেন কেন রক্তক্ষরণ হচ্ছে। পলিকে ওটিতে নিয়ে যায়। এরপর জানায়, ইন্টার্নাল ব্লিডিং হচ্ছে। জরায়ুর কোনো একটা সমস্যার কথা জানায়। বলে, আমার স্ত্রীকে বাঁচাতে হলে জরায়ু কেটে ফেলতে হবে। আমি সম্মতি দিলে জরায়ু কেটে ফেলা হয়। এরপরে তারা আমার স্ত্রীকে আবার আইসিইউতে শিফট করে।

পরদিন মঙ্গলবার (১৯ মার্চ) সকাল থেকে সন্ধ্যার ঘটনাপ্রবাহ তুলে ধরে আশীষ বলেন, সকাল ১০টার দিকে আমাকে রক্ত জোগাড় করতে বলে। আইসিইউ থেকে প্রায় ৫০-৬০ হাজার টাকা ওষুধ কিনে আনতে বলে। স্ত্রীকে বাঁচানোর জন্য তাদের কথামতো সবই করছিলাম। ওই সময় আইসিইউ ইনচার্জ বলেন, পলিকে ভেন্টিলেশন সাপোর্ট দিয়ে রেখেছে। ভালো-খারাপ যেকোনো কিছুই ঘটতে পারে। পরে বিকেল ৩টার দিকে একজন হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ এনে তারা ইকো করে আমাকে জানায়, পলির নাকি ম্যাসিভ কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়েছে। তাদের আর কিছুই করার নেই। সবশেষে সন্ধ্যা ৬টার দিকে ওরা পলিকে মৃত ঘোষণা করে।

আশীষ রয় বলেন, আগের দিন থেকেই বারবার বলছিলাম, পলির রক্তক্ষরণ হচ্ছে। অথচ তারা সেটাকে গুরুত্বই দিলো না। তারা বলল কমে যাবে, কমে গেছে। কিন্তু সারারাত ওর রক্তক্ষরণ হয়। এ কারণেই যখন ওর অবস্থা বেশি খারাপ হয়ে যায়, তখন আইসিইউতে নিয়ে চার-পাঁচ ব্যাগ রক্ত জোগাড় করতে বলেন। অথচ সবকিছুই তারা অনেক আগেই করতে পারত। সবই অবহেলার কারণে হয়েছে। তারা আমাদের আকুতিকে কোনো পাত্তাই দিতে চায়নি।

বিজ্ঞাপন

অভিযোগ তদন্তে ৪ সদস্যের কমিটি

এদিকে কর্তব্যরত চিকিৎসকের অবহেলায় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে পলি সাহার মৃত্যু হয়েছে— এমন অভিযোগ করেছেন আশীষ রয়। তার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ঘটনাটি তদন্তে চার সদস্যের কমিটি গঠন করেছে ইবনে সিনা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। কমিটিকে সাত কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।

বুধবার (২০ মার্চ) ইবনে সিনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক (প্রশাসন) এবং ইউনিট ইনচার্জ অধ্যাপক ডা. মো. নজরুল ইসলামের সই করা এক আদেশে এই তদন্ত কমিটি গঠনের কথা জানানো হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, পলি সাহার মৃত্যুর প্রকৃত কারণ উদ্‌ঘাটন ও প্রতিবেদন প্রদানের জন্য চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হলো।

কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে হাসপাতালটির সাবেক অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান (অবস্ অ্যান্ড গাইনি) অধ্যাপক ডা. ফারহানা দেওয়ানকে, সদস্যসচিব করা হয়েছে আইএসএমসিএইচ বিভাগের চিফ মেডিকেল অফিসার ডা. আব্দুস সোবহান মুন্সীকে। সদস্য হিসেবে রাখা হয়েছে অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান (অবস্ অ্যান্ড গাইনি) ডা. নূর সাঈদা ও আইএসএমসিএইচর সহযোগী অধ্যাপক ডা. এ কে এম মহিউদ্দীন ভূঁইয়াকে।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ডা. শারমিন মাহমুদ তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের জন্য অপেক্ষা করতে বলেন। হাসপাতালের আইসিইউ ইনচার্জসহ অন্য চিকিৎসকরাও কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

সারাবাংলা/এসবি/টিআর

Tags: , , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন