October 7, 2018 | 6:07 pm
তুহিন সাইফুল, এন্টারটেইনমেন্ট করেসপন্ডেন্ট ।।
মিসির আলি এমন একটি চরিত্র, যিনি দেখার চেষ্টা করেন চোখ বন্ধ করে। এই চরিত্রটিকে ঘিরে প্রয়াত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ যে গল্পগুলো লিখেছেন সেগুলো ঠিক গোয়েন্দাকাহিনী কিংবা চোর-পুলিশের ধাওয়া-পাল্টা-ধাওয়া নয়। বরং যাপিত জীবনে ঘটে যাওয়া নানা সমস্যার মনস্তাত্ত্বিক ও যুক্তিনির্ভর বর্ণনা। মিসির আলী সিরিজের প্রথম বই ‘দেবী’ থেকে এবার নির্মিত হয়েছে সিনেমা। যেখানে রহস্যময় একলা মানুষের এই চরিত্রটিতে অভিনয় করেছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারজয়ী অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরী। আজকে শুনবো তার কথা…
একটা মানুষের তো অনেক স্বপ্ন থাকে। সব স্বপ্ন তো আসলে পূরণ হয় না। একজন মানুষ অনেক অনেক কিছুই হতে চায়, এটা প্রত্যেকটা মানুষই চায়। কারণ বিভিন্ন মানুষ বিভিন্ন পেশার প্রতি বিভিন্ন রকমের নেশা থাকে। যেমন ছোটবেলা থেকেই আঁকাআঁকি আমার পছন্দ ছিলো। টুকটাক গান করতাম। আবার পুরনো দিনের সেই ছবিগুলো যখন দেখতাম, রাজ্জাক-শাবানা-কবরীর অভিনয় যখন দেখতাম, সাদাকালোর সময়ের কথা বলছি, ওই অভিনয়ের প্রতিও এক ধরনের লোভ এবং ঝোঁক ছিলো যে অভিনয় করবো। আসলে প্রফেশন হিসেবে যে আমি অভিনয়কে বেছে নেবো বা এটাই আমার সর্বশেষ গন্তব্য হবে এমনটা ভাবিনি। মনের ভিতর ইচ্ছাগুলো ছিলো, আঁকাআঁকি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলায় পড়েছি, গানবাজনার শখ ছিলো, টুকটাক গান বাজনাও করি।
আর অভিনয়টা! আসলে শখের তো কোন শেষ নেই। একটা সময় শখ হতো যখন আমি স্কুলে-কলেজে পড়ি, তখন ভাবতাম পুলিশে চাকুরী করবো। সার্জেন্ট হবো। মোটরসাইকেল নিয়ে আমি বসে থাকবো মোড়ের মধ্যে। তার কতো ক্ষমতা। হাতের ইশারায় ট্রাক-বাস সব থেমে যায়, গোটা শহর থেমে যায়। এই রকম আরকি। তারপর একবার ভারতে যাচ্ছিলাম, কলকাতায়। তখন দেখলাম শতশত মানুষ দাঁড়িয়ে আছে কাস্টম অফিসারের সামনে, তখন সেটা হতে ইচ্ছা করলো। ছোটবেলায় আমার দাঁতের সমস্যা ছিলো, দাঁত পোকায় খেয়ে ফেলছিলো, ব্যাথাও ছিলো। তখন মনে হতো, দাঁতের ডাক্তার হবো। একটা মানুষের ভেতর নানান ইচ্ছাই হতে পারে আসলে কিন্তু সেই ইচ্ছাগুলোর মধ্যে কোন ইচ্ছাটি তার পূরণ হবে সে নিজেও জানে না। ইচ্ছা পূরণের ক্ষেত্রে অনেক কিছুই তো মানুষ হতে চায়, তারমধ্যে কোন সে আসলে হওয়ার যোগ্য একটা সময়ে গিয়ে সেই সিদ্ধান্তটা সে নিতে পারে।
এই যে আমার এতো কিছু হওয়ার ইচ্ছা ছিলো আমি তো ডাক্তার হতে পারিনি, সেই যোগ্যতা আমার ছিলো না। আমি পুলিশ হতে পারিনি, কাস্টমস অফিসার হতে পারিনি, সংগীত শিল্পী অথবা চিত্রশিল্পী হতে পারিনি। আঁকায় পড়াশোনা করেছি কিন্তু আমি তো আসলে আঁকিয়ে হইনি। আমার মনে হয় অভিনয়ের জায়গাটিই আমার ছিলো। শেষপর্যন্ত আমি এখানেই নোঙ্গর ফেলেছি।
এটিএম শামসুজ্জামান ভাই অনেক মজা করে একটা কথা বলেছিলেন, এটা উনি আমার বিয়ে প্রসঙ্গে বলেছিলেন। আমি বিয়ে করার পর আমার শ্বশুর-শ্বাশুড়ি সেটা মেনে নেননি। আমার বউ ডাক্তার, তাদের ইচ্ছে ছিলো ডাক্তার ছেলের সঙ্গেই মেয়েকে বিয়ে দেবেন। এটা এটিএম ভাই জানার পর আমাকে বললেন, ‘তাদের না মানার তো কোন কারণে নেই। তুমি তো অভিনেতা। তুমি কখনো ডাক্তারের চরিত্রে, কখনো ইঞ্জিনিয়ারের চরিত্রে অভিনয় করবে। এটা তো আরো ভালো। তোমাকে তো তারা সব চরিত্রেই দেখবে।’
এটা একটু কষ্টেরও… একটু না, অনেকখানি কষ্টের। আমরা যখন অভিনয় শুরু করি, আমাদের ধ্যান-জ্ঞান আসলে টেলিভিশনই ছিলো। আর স্বপ্ন ছিলো চলচ্চিত্র। সেই জায়গায় যেখানে ধ্যান-জ্ঞান ছিলো, সেখানে বেশ যত্নের সঙ্গেই আমরা কাজ করেছি, কাজের পরিবেশটা আস্তে আস্তে নষ্ট হতে হতে, সীমাবদ্ধতার জায়গাটা বাড়তে বাড়তে এমন একটা জায়গায় এসেছে যে নাটকের মান অনেক কমে গেছে, বাজেট কমে গেছে। এর কারণটা হচ্ছে এখানে প্রচুর নন প্রফেশনাল লোক, যাদের এই কাজটি করার কথা নয়, তারা শখের বশে হোক অথবা যেকোন কারণেই হোক, এখানে এসে ভিড় জমিয়েছে।
যার অভিনয় করার কথা নয়, সে অভিনয় করছে। যার ডিরেকশন দেয়ার কথা নয় সে ডিরেকশন দিচ্ছে। যার লেখা লেখি করার কথা নয়, সে লিখছে। যাই পারুক লিখছে। যে কাজটি যার কার উচিত, যার সেই যোগ্যতা আছে সেই তো সেই কাজটা করবে। কিন্তু এখানে দেখা যাচ্ছে যে এখন নাটকের মধ্যে এখন অনেক অনাহুত লোকের ভিড় বেড়ে গেছে। এবং তারা এই জায়গাটাকে নষ্ট করছে। কারণ এই কাজটি করার জন্যে যে প্রিপারেশন গুলো নেয়ার দরকার, সেটা ছাড়াই বেশির ভাগ মানুষ সেটা করছে। যে কারণে কোয়ালিটি ফল করছে।
কারা টিকছে আর কারা টিকছে না সেটা নির্ভর করে যোগ্যতার উপর। সে যদি নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করতে পারে তাহলে সে টিকে যাবে। নাই নাই বলতে আমাদের অভিনেতা অভিনেত্রীদের কিন্তু অনেক ঘাটতি। আমরা মনে করছি যে নতুন কেউ টিকতে পারছে না কিন্তু ভালো অভিনেতা অভিনেত্রীর কিন্তু মিডিয়াতে অনেক আকাল। বলতে শোনা যায় সাড়ে সাতশ অভিনেতা-অভিনেত্রী আছেন আমাদের আর্টিস্ট ইকোইটিতে। সাড়ে চারশ পরিচালক আছেন ডিরেক্টরস গিল্ডে। নাট্যকারও আছেন দেড়শর মতো। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে যারা ভালো কাজ করছেন তারা টিকে যাবে। যারা টিকতে পারছে না আমি মনে করি তাদের মধ্যে কোনো না কোনো ঘাটতি আছে। দর্শকের মধ্যে নিজের গ্রহণযোগ্যতাটা যদি কেউ তৈরী করতে পারে। তার লেখা দিয়ে, তার পরিচালনা দিয়ে। তার অভিনয়ের যোগ্যতা দিয়ে, তাহলে সে অবশ্যই টিকে যাবে। আর এটা তো একজনের কাজ না।
একজন চঞ্চল চৌধুরী বা মোশাররফ করিম বা জাহিদ হাসান বা এমন চার পাঁচজনের জন্য তো মিডিয়া না, এখানে তো আরো অনেক শিল্পী দরকার। এবং এই কয়জন শিল্পীর উপর বেশি প্রেশার পড়ার কারণে কাজের মানটা কিন্তু নষ্ট হচ্ছে। আমার যে কয়টা কাজ করতে পারলে আমি মনোযোগ দিয়ে করতে পারবো, তার তুলনায় যদি আমাকে দশগুন বেশি কাজ করতে হয়, তাহলেই আমার মান ধীরে ধীরে কমে যাবে। কারণ আমার মাথার উপর চাপ আছে, আমাকে করে দিতে হবে। চ্যানেলের প্রেশার, পরিচালকের প্রেশার, এখন তো হয়েই গেছে এমন হাতে গোনা চার-পাঁচজন শিল্পীকে বেজ করে নাটক তৈরী হয়। কিন্তু এটা তো হওয়ার কথা ছিলো না। এই মানের শিল্পীর দরকার বাংলাদেশে বিশ-পঁচিশজন। তাহলে সবারই সমবণ্ঠন হবে কাজের। ভালো অভিনেতা-অভিনেত্রীরা সবাই যদি কাজ পায় তাহলে কাজের মানও ঠিক থাকে। ওভার প্রেশার… ঈদে একজনের চল্লিশ-পঞ্চাশটা নাটকের চাপ থাকলে, করলে, তার কোয়ালিটিটা কোথায় থাকবে! এটাও তো হচ্ছে!
আমি আসেল সিনেমার মানুষ নাকি নাটকের মানুষ সেটা বলবো না। আমি আসলে অভিনেতা। আমি অভিনয়ের মানুষ এটাই হচ্ছে আমার সবচেয়ে বড় পরিচয়। আমি টেলিভিশনে অভিনয় করবো, মঞ্চে অভিনয় করবো, আমি সিনেমায় অভিনয় করবো। আমি অভিনেতা এবং সেই ধারাবাহিকতাটা আমি রাখতে চাই আমাকে যেকোন পরিচয়ে… মঞ্চে তো আমার হাতেখড়ি, কেউ যদি আমাকে মঞ্চঅভিনেতা বলে আমি আরো বেশি খুশী হই। টেলিভিশনের বললেও আমার কোন আপত্তি নাই। ঘরে ঘরে প্রত্যেকটা মানুষ যখন দেখে, আপন মানুষ ভাবে, এটাও আমার অনেক বড় অর্জন। সিনেমার বড় পর্দায় দেখে যখন হাসে-কাঁদে, ওইটা আমার বড় প্রাপ্তি। সো আমার অভিনেতা পরিচয়টাই বড়, আমি নিজেকে সেটাই মনে করি। কোথায় অভিনয় করলাম সেটা বড় কথা নয়। দর্শকের ভাললাগাটা যদি আমি তৈরী করতে পারি, সেটাই আমার জন্য বিশেষ কিছু হবে।
এই হিট-ফ্লপের হিসেবটাও আমি করিনা। এটা করেন প্রযোজকরা। তারা টাকাটা লগ্নি করেন, সেটা তুলতে হয়। সিনেমা করে তাদেরকে লাভ করতে হয়। হিট না হলে পড়ে সে হুমকির মুখে পড়ে যায়। আমার উদ্দেশ্য কিন্তু হিট সিনেমা বা ফ্লপ সিনেমা না। আমি চেষ্টা করি যে একটা ভালো সিনেমায় অভিনয় করবো। ওই সিনেমার কোয়ালিটিটা আমার কাছে প্রধান। সেই সিনেমা হিট করলে ভালো। দর্শকগ্রহণ করলে পড়ে ভালো। গ্রহণ না করলে আমার কাছে খারাপ লাগে। কিন্তু ভাল সিনেমাটাই আমি করতে চাই। যে কারণে আমার সিনেমার সংখ্যা হাতে গোনা যায়। যে কয়টি সিনেমা করেছি ভালো নির্মাতা, ভালো গল্প, ভালো চিত্রনাট্য, ভালো সহশিল্পী পেতে চেয়েছি।
আর মিডিয়াটা তো একটা বিশাল জায়গা। এর বাইরে তো এখন ইন্টারনেটের যুগ, ফেসবুক-ইউটিউব মিলিয়ে জায়গাটা বিশাল। এই জায়গায় কার নজর কার দিকে কতটুকু দিবে সেটা কাজের উপর নির্ভর করে। আমি যদি মেনে নেই যে হ্যা এটাই আমার লিমিট। আমাকে দশজন দর্শক ভালোবাসে সেটাই আমি মেনে নেব। এটা তো একেবারে দর্শকের রুচির উপর নির্ভর করছে যে সে কাকে প্রায়োরিটি দিবে! সে শাকিব খানকে প্রায়োরিটি দিবে, নাকি চঞ্চল চৌধুরীকে প্রায়োরিটি দেবে, নাকি মোশাররফ করিমকে দিবে সেটা দর্শকের নিজের বিচার বিবেচনা। এরা যার যার কাজ দিয়ে তাকে বিচার করবে। তারাই বলবে কে সেরা, কার জায়গা কোথায়? আমার দায়িত্ব কাজটা করে যাওয়া, আমি সততার সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে সেটা করে যাচ্ছি। আমি শুধু চেষ্টা করি অন্য কোন হিসেব না করে মনোযোগ দিয়ে কাজটা করা। আমার যতটুকো অভিজ্ঞতা ও যোগ্যতা আছে সেটুকো আমার কাজে আমি লাগাই।
শিল্পীর কোন সন্তুষ্টি নেই। সন্তুষ্টির কোন লিমিট নাই। আমি আমৃত্যু অভিনয়ে থাকতে চাই। আমি জানি না আমার জীবনের সেরা কাজ কোনটা হবে। আমি সবসময় একটা চলমান নিয়মের ভেতর দিয়ে কাজ করি। আমি আছি…চলমান। সেই চলান জায়গায় থেকে আবার একটা ‘আয়নাবাজি’ হবে কিনা, আবার একটা ‘দেবী’ হবে কিনা, আবার একটা ‘মনপুরা’ হবে কিনা, এটা যেমন আমি জানি না। আবার এমনও হতে পারে এরচেয়ে ভালোছবি বাংলাদেশে আসবে সেখানে আমি অভিনয় করবো। আমি না করি আরেকজন করবে। এটার কোন সীমানা নাই। কোন নিয়ম নাই। অভিনয় করি কখনো ভাবিনা এটাই শেষ বা এটাই শুরু। বা এটাই আমার সেরা কাজ।
‘দেবী’ হুমায়ূন আহমেদের অনেক জনপ্রিয় একটি উপন্যাস। তার যতোগুলো চরিত্র আছে, তার মধ্যে মিসির আলি অনেক বেশি বিখ্যাত চরিত্র। সেই জায়গা থেকে আমি বলি যে এমন একটি ছবিতে অভিনয় করা বা এমন চরিত্রে অভিনয় করাটা সৌভাগ্য। সবাইকে দিয়ে তো আর করা হয়ে উঠে না। সেই জায়গা থেকে, ‘দেবী’ প্রিয় একটি উপন্যাস। হুমায়ূন আহমেদ প্রিয় একজন লেখক। ওনার লেখার একটা মজা হচ্ছে, একলাইন পড়লে আরেক লাইন পড়তে ইচ্ছে করে। একপৃষ্টার পর মনে হয় পরের পৃষ্ঠাটা পড়ি। সবকিছু মিলিয়ে তার যে অবস্থান রয়েছে বাংলা সাহিত্যে, দেবীরও যে জায়গাটা আছে, সেখানে বলা যায় ছবিটাও বেশ ভালো হয়েছে।
এটা তো হঠাৎ করে আসলে হয় না। প্রস্তাবটা পাওয়ার পর থেকে মানসিকভাবে প্রস্তুতি নেওয়া, তারপরে অভিনয় করার জন্য যা যা প্রস্তুতি লাগে, মিসির আলি হয়ে উঠার জন্য যতোটা পরিশ্রম করতে হয় সেটা আমাকে করতে হয়েছে। টিম করে কাজ করতে হয়েছে। ‘দেবী’র পরিচালক থেকে শুরু সবাই আমাকে বেশ সাহায্য করেছে যেন আমি মিসির আলি হয়ে উঠতে পারি। চরিত্রটি যেন দর্শকের কাছে অনেক জীবন্ত একটি চরিত্র হয়ে উঠে, গ্রহণযোগ্য চরিত্র হয়ে উঠে এর জন্য করণীয় সবই করেছি আসলে। সেই জায়গা থেকে আমি আশাবাদী যে ছবিটি সবার ভালো লাগবে। মিসির আলির যে চরিত্রটি প্রথমবারের মতো প্রেক্ষাগৃহে আসছে, সেই মিসির আলিকে সবাই পছন্দই করবে। আর দুনিয়াতে এমন কোন কাজ নেই শতভাগ দর্শক কাজটা পছন্দ করে। কারো কারো হয়তো ভালো নাও লাগতে পারে। একেবারেই তার নিজস্ব রুচির এটা। একেবারেই আমি আশাহত হবো না। তবে বেশিরভাগ দর্শকেরই সিনেমাটা ভালো লাগবে।
ছবি: আশীষ সেনগুপ্ত
সারাবাংলা/টিএস/পিএম
সারাবাংলা’য় আড্ডা। অতিথি : শিমুল মুস্তাফা। উপস্থাপনা : পলাশ মাহবুব