বিজ্ঞাপন

টেন্ডার জালিয়াতি! ২৫০ কোটি টাকায় ইএফডি দিচ্ছে চীনা কোম্পানি

July 24, 2019 | 2:43 pm

শেখ জাহিদুজ্জামান, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: অভিজ্ঞতাহীন একটা চীনা কোম্পানি পাচ্ছে দেশের অনলাইনে ভ্যাট আদায়ের কাজ। আর সে কাজ পাইয়ে দিতে অনেকটা জালিয়াতির আশ্রয় নিচ্ছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। ভাঙতে হয়েছে টেন্ডারের শর্ত। সক্ষমতার বিচারে সবচেয়ে নিচে থাকা চীনা কোম্পানি এসজেডজেডটি স্রেফ দরপত্রে কম দর দিয়েই এই কাজ পাচ্ছে। যা নিয়ে গুঞ্জন উঠেছে খোদ এনবিআর’র ভেতরে। এদিকে সিদ্ধান্ত একেবারে শেষ পর্যায়ে রয়েছে। বুধবার (২৪ জুলাই) ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে বিষয়টি পাশ করে নেওয়ার চেষ্টা চলছে।

বিজ্ঞাপন

দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের গুরুত্বপূর্ণ ইলেট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস (এফএফডি) ও সেলস ড্যাটা কন্ট্রোলারসহ (এসডিসি) ফিসক্যাল ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (ইএফডিএমএস) কেনার দরপত্র আহ্বান ও মূল্যায়নেই এই বড় ধরনের অনিয়ম ও জালিয়াতির আশ্রয় নেওয়া হয়েছে।

ইএফডি নামে যে প্রযুক্তি স্থাপন করা হবে, তা বাস্তবায়নে চীনা প্রতিষ্ঠান এসজেডজেডটি’কে দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে। যদিও তাদের পূর্বের অভিজ্ঞতা নেই। এমনকি টেন্ডারে উল্লেখ করা অভিজ্ঞতার তথ্যও সঠিক নয়।

সূত্র জানায়, সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে চারটি প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে গঠিত চীনা জয়েন্টভেঞ্চার এসজেডজেডটি-কেএমএমটি-সিনেসিস ইএটিএল এর কাছ থেকে ১ লাখ ইউনিট ইএফডি ও ৫শ ইউনিট এসডিসি কেনার প্রস্তাব করা হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

প্রতিযোগী দরদাতারা দাবি করেছেন, তাদের তৈরিকৃত এ ধরনের যন্ত্র ও সিস্টেম পৃথিবীর কোনো দেশে সফলভাবে ব্যবহৃত হয়নি। তারা এরই মধ্যে সুনির্দিষ্ট তথ্য হাজির করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কাছে অভিযোগও করেছেন। একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র সারাবাংলাকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।

সূত্র আরও জানায়, চীনা প্রতিষ্ঠানটিকে কাজ পাইয়ে দিতে দুই দফা মূল্যায়ন প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। প্রথম মূল্যায়ন প্রতিবেদনে কেন প্রতিষ্ঠানটিকে কাজ দেওয়া হচ্ছে তার উল্লেখ ছিল না। পরে সেটা সরিয়ে আরেকটি মূল্যায়ন প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়। সরাসরি এনবিআর চেয়ারম্যানের ফরমায়েশে দু’টি প্রতিবেদন করা হয়েছিল বলে বোর্ড কার্যালয়ের দায়িত্বশীল ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

সূত্র নিশ্চিত করেছে, দ্বিতীয় মূল্যায়ন প্রতিবেদনে ক্রয় কমিটির জন্য তৈরি করা সারসংক্ষেপেও উল্লেখ করা হয়নি।

বিজ্ঞাপন

এদিকে দরপত্র থেকে কাজটি পাইয়ে দেওয়ার পুরো প্রক্রিয়াতেই বেশ কিছু অনিয়মের কথা জানিয়েছে সূত্র। তারা জানিয়েছে, ক্রয় প্রস্তাবের অনুমোদন না নিয়েই এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়েছে। এছাড়া দরপত্র খোলার পর দীর্ঘ পাঁচ মাস ফেলে রাখা হয়।নতুন ভ্যাট আইন আসার পরপরই তড়িঘড়ি করে বিষয়টি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে পাঠানো হলো।

এই দরপত্র আহ্বানে ‘এক ধাপ দুই খাম’ (one stage two envelope) পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে। দাবি করা হয়েছে, সিপিটিইউ এর স্ট্যান্ডার্ড টেন্ডার ডকুমেন্ট অনুসরণ করেছেন তারা। তবে এনবিআর’র একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, সিপিটিইউ-এর স্ট্যান্ডার্ড টেন্ডার ডকুমেন্ট (এসটিডি) ফর প্রকিউরমেন্ট অব গুডস (ইন্টারন্যাশলাল) ওপেন টেন্ডারিং মেথডে এক ধাপ দুই খাম বলে কোনো পদ্ধতিই নেই।

তারা আরও জানিয়েছেন, ক্রয় আইন- পাবলিক প্রকিউরমেন্ট অ্যাক্ট বা ক্রয় বিধিমালা-পিপিআর এ আন্তর্জাতিক দরপত্রে পণ্য ক্রয়ের ক্ষেত্রে এই এক ধাপ দুই খাম’ বলে কোনো ক্রয় পদ্ধতির অস্তিত্ব নেই।

সূত্র জানায়, সাপ্লাই, ইনস্টলেশন অ্যান্ড কমিশনিং অ্যান্ড অপারেশন অব ইলেট্রনিক ফিসক্যাল ভিভাইজ ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমস (ইএফডিএমএস) এলং উইথ ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস (ইএফডি), সেলস ডাটা কন্ট্রোলার (এসডিসি) অ্যান্ড ম্যানেজড সার্ভিসেস নামে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য ২০১৮ সালের ১২ ডিসেম্বর ই-টেন্ডার আহ্বান করা হয়। জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ছিল চলতি বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি।

বিজ্ঞাপন

প্রকল্পটির টেন্ডারিং প্রক্রিয়ায় বলা ছিল, প্রথমে টেকনিক্যাল প্রপোজালের ওপর মূল্যায়ন এবং পিওসি পরীক্ষা করে পরবর্তীতে সর্বনিম্ন দরদাতাকে বিজয়ী ঘোষণা করা হবে। কিন্তু এই প্রতিশ্রুতি রাখেনি এনবিআর।

টেন্ডার ওপেন করে তিনটি সর্বনিম্ন দরতাদা প্রতিষ্ঠানকে বেছে নেয় এনবিআর। এর মধ্যে সবচেয়ে কম দর প্রস্তাব করেছে চীনের প্রতিষ্ঠান এসজেডজেডটি (এসজেডজেডটি) (টাকার অঙ্কে ২৪৭ কোটি ৭৭ লাখ ৭৩ হাজার ৪৫১ টাকা ৪৪ পয়সা)। বাংলাদেশের সিনেসিস আইটি’র সাথে যৌথভাবে তারা কাজ করবে।

দরপ্রস্তাবে এরপরের অবস্থানে ছিল ইন্সপার অ্যান্ড টেকনোভিসতা লিমিটেড তারা দেয় (টাকার অঙ্কে ২৫৮ কোটি ১৬ লাখ ৫৩ হাজার ৫২৯ টাকা) আর সর্বনিম্ন তিনটি দরদাতা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দর দেয় ডেইসি অ্যান্ড স্মার্ট (টাকার অঙ্কে ৩২৯ কোটি ৬০ লাখ ৭০ হাজার ৪৫৫ টাকা ৪০ পয়সা)।

এই তিনটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে প্রকল্প বাস্তবায়নে কাজ পেতে যাওয়া এসজেডজেডটি যে তিনটি দেশে (রাশিয়া, বেলারুশ ও ভারত) তাদের অভিজ্ঞতার কথা টেন্ডারে উল্লেখ করেছে সেগুলো সংশ্লিষ্ট প্রকল্পের জন্য সাদৃশ্যপূর্ণ নয় বরং দেওয়া হয়েছে মিথ্যা তথ্য, জানায় সূত্র।

বিষয়টি সামনে এনে এরই মধ্যে নিকটতম দরদাতা অন্য দুই প্রতিষ্ঠানই সংশ্লিষ্ট দফতরে চিঠি দিয়েছে। তাতেও চীনা প্রতিষ্ঠানটির অযোগ্যতার নানা তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, এসজেডজেডটি রাশিয়ায় কাজ করার কথা বললেও সেবাদাতা হিসেবে ওই দেশে তালিকাভুক্ত নয় তারা। এছাড়া এথ্রিওয়াইপি-০১ মডেলের যে ডিভাইসের কথা বলা হয়েছে, তা মূলত তৈরি করেছে এজেডইউআর । এই প্রতিষ্ঠানটি পজ মেশিন সরবরাহ করে। এসজেডজেডটি প্রতিষ্ঠান ‘এজেডইউআর’ এর জন্য সামান্য কিছু ওইএম তৈরি করে। অর্থাৎ এটা স্পষ্ট যে, রাশিয়ার এফটিএস এর জন্য একই ধরনের ইএফডিএমএস ব্যাক অ্যান্ড সিস্টেম সরবরাহ করেনি এসজেডজেডটি চীনা প্রতিষ্ঠান।

একইভাবে এসজেডজেডটি চীনা প্রতিষ্ঠান বেলারুশের জন্যও এফসিআর/এসডিসি বা ব্যাকেন্ড সিস্টেম ইএফডিএমএস সরবরাহ করেনি। ওই দেশে এসজেডজেডটি’র অংশীদার প্রতিষ্ঠান শুধু ক্রিপ্টোগ্রাফি সরবরাহকারী। অন্যদিকে ভারতের জন্যও একই ধরনের এফসিআর/এসডিসি পণ্য সরবরাহ করেনি এসজেডজেডটি । শুধুমাত্র স্থানীয় অংশীদার প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পিওএস টার্মিনাল (অনলাইন রাজস্ব ফাংশন ব্যতীত) তৈরি করে। উল্লেখযোগ্য তথ্য হলো, ভারত কখনোই ইএফডিএমএস এর মতো অনুরূপ সিস্টেম বাস্তবায়ন করেনি।

মিথ্যা তথ্যের ভিত্তিতে অভিজ্ঞতাহীন এসজেডজেডটিকে টেন্ডারে বিজয়ী ঘোষণা করে ২৪৭ কোটি ৭৭ লাখ ৭৩ হাজার ৪৫১ টাকা ৪৪ পয়সার কাজ পাইয়ে দিচ্ছে এনবিআর। সংশ্লিষ্ট অনেকেই এতে বড় ধরনের জালিয়াতির গন্ধ পাচ্ছেন। তারা বলছেন, পিওসি পরীক্ষায় চীনা প্রতিষ্ঠান এসজেডজেডটি’র অনেক দুর্বলতা থাকলেও এনবিআরের জোরালো দাবির কারণে প্রতিষ্ঠানটি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে।

সূত্র জানায়, চলতি বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি এই টেন্ডারটির ওপেনিং কমিটিতে ছিলেন ভ্যাট অনলাইন প্রজেক্টের ডেপুটি প্রজেক্ট ডিরেক্টর শামীম আরা বেগম, ডেপুটি কমিশনার মো. খায়রুল আলম ও ডেপুটি কমিশনার রাবেয়া খাতুন। দরপত্র মূল্যায়ন কমিটিতে ছিলেন এনবিআরের সদস্য ও সিস্টেম ম্যানেজার মো. শফিকুর রহমান, ভ্যাট অনলাইনের প্রকল্প পরিচালক সৈয়দ মুশফিকুর রহমান, ভ্যাট অনলাইন প্রজেক্টের ডেপুটি প্রজেক্ট ডিরেক্টর শামীম আরা বেগম, আইসিটি ডিভিশনের সিনিয়র সিস্টেম অ্যানালিস্ট মো. নবীর উদ্দীন, বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের অ্যাডমিনিস্ট্রেটর সুমন কুমার পাটয়ারী, বৃহৎ করদাতা ইউনিটের কমিশনার মোহাম্মদ মুবিনুল কবীর, এনবিআর-এর মূসক ও ভ্যাট নীতি মেম্বার ড. আব্দুল মান্নান শিকদার। পুরো প্রক্রিয়ার অনিয়মে এদের সকলেরই দায় রয়েছে বলে জানাচ্ছে এনবিআর সূত্র।

এ বিষয়ে জানতে সারাবাংলার পক্ষ থেকে এনবিআর এর মূসক ও ভ্যাট নীতি মেম্বার ড. আব্দুল মান্নান শিকদার, ভ্যাট অনলাইনের প্রকল্প পরিচালক সৈয়দ মুশফিকুর রহমান, বৃহৎ করদাতা ইউনিটের কমিশনার মোহাম্মদ মুবিনুল কবীর এর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ড. আবদুল মজিদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘ইএফডি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি মেশিন। এখানে দুনীর্তি কাম্য নয়। এনবিআর কেন ভ্যাট মেশিন কিনে দেবে? এনবিআর ব্যবসায়ীদের মেশিন কিনতে বলবে তারা তাদের মতো করে কিনবে। এরপর না কিনলে ব্যবস্থা নেবে। এখন মেশিন কিনতে দুর্নীতির কথা হচ্ছে। এতে এনবিআরের সুনাম নষ্ট হচ্ছে। এটা কখনো আশা করা যায় না। একই সাথে ভ্যাট সিস্টেম অনলাইন হতেও সময় লাগছে।

এ বিষয়ে এনবিআর চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়াকে একাধিকবার তার ব্যক্তিগত ফোনে কল দেওয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি।

সারাবাংলা/এসজে/এমএম

Tags: , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন