বিজ্ঞাপন

বছরজুড়ে ‘শক্তিশালী’ করোনা, শেষভাগে ভ্যাকসিনের আশাবাদ

January 2, 2021 | 11:11 am

সৈকত ভৌমিক, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: ২০১৯ সালের শেষ মাসে এসে চীনের উহানে রহস্যময় এক ভাইরাসের দেখা মেলে। ওই বছরের ডিসেম্বর মাস শেষ হতে না হতেই 2019-nCoV বা সার্স-কভ-২ নামের ভাইরাসটি চীনের জন্য আতঙ্ক হয়ে দাঁড়ায়। তখনো কেউ ধারণাও করেনি, মহাসংক্রামক এই ভাইরাসটি পরবর্তী বছর, অর্থাৎ ২০২০ সালে সারাবিশ্বের জন্য মূর্তিমান আতঙ্ক হয়ে দাঁড়াবে। পরে ঘটলো ঠিক সেটিই। বছরজুড়ে সারাবিশ্বকে নাকানি-চুবানি খাইয়েছে এই ভাইরাস।

বিজ্ঞাপন

সরাবিশ্বের সব দেশের মতো করোনাভাইরাসের সংক্রমণে ভুগেছে বাংলাদেশও। চীনে করোনা সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর থেকেই শুরু হয় উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই ভাইরাস ঘিরে বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য সতর্কতা জারি করলে ভাইরাস প্রতিরোধে আরও বেশি সক্রিয় হয়ে ওঠে সরকার। তবে শুরুর দিকে এই ভাইরাসকে গুরুত্ব না দিয়ে মৌখিকভাবে সব প্রস্তুতির কথা বলা হলেও ধীরে ধীরে পরিকল্পনা অনুযায়ী এগুতে থাকে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা। ধীরে ধীরে বিমানবন্দরে স্ক্রিনিং, কোয়ারেনটাইন, নমুনা পরীক্ষা, আইসোলেশন, চিকিৎসকদের সুরক্ষা সামগ্রী (পিপিই) বিতরণ থেকে শুরু করে চিকিৎসকদের আবাসন ব্যবস্থাপনা, হাসপাতালে সেন্ট্রাল অক্সিজেন ব্যবস্থাপনা, আইসিইউ বেড, ভেন্টিলেটরের মতো বিষয়গুলো নিয়ে কাজ হতে থাকে।

তবে এসব বিষয় নিয়ে সরকারের বিভিন্ন কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্নও ওঠে ব্যাপকভাবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, যথাসময়ে দেশে ‘সাধারণ ছুটি’ ঘোষণা করা হলেও মানুষের মাঝে আস্থা গড়ে তুলতে না পারায় বাড়তে থাকে ভীতি। এর সঙ্গে নানা রকমের সমন্বয়হীনতা ও দুর্নীতির বিষয় সাধারণ জনগণের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক ছড়ায়। বছরের শেষ ভাগে এসে অবশ্য করোনার ভ্যাকসিন আশার আলো হয়ে দাঁড়িয়েছে।

প্রাথমিক প্রস্তুতি

বিজ্ঞাপন

চীনের উহান থেকে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাস মারাত্মক রকমের ছোঁয়াচে হতে পারে বলে আশঙ্কা জানায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। মূলত ওই সময় থেকেই বাংলাদেশে নানা ধরনের প্রস্তুতি শুরু হয়। প্রাথমিক পর্যায়ের প্রস্তুতির মধ্যে ছিল স্বাস্থ্যকর্মী ও বিমানবন্দরকর্মীদের প্রশিক্ষণ, পরীক্ষাগার প্রস্তুত করা এবং স্ক্যানারসহ বিভিন্ন যন্ত্রপাতি বসানো। বিমানবন্দরে স্বাস্থ্য অধিদফতরের নিয়মিত দায়িত্ব পালন করা ১৪ জন স্বাস্থ্যকর্মীর সঙ্গে আরও ১০ জনকে নিয়োজিত করা হয়। সেই সঙ্গে একজন নার্স ও একজন চিকিৎসককে যুক্ত করা হয়।

এছাড়াও প্রাথমিক ব্যবস্থাপনায় দেশের বাইরে থেকে আসা প্রত্যেক যাত্রীকে থার্মাল ক্যামেরা স্ক্যানার পার হয়ে দেশে প্রবেশ করে স্ক্রিনিং করার ব্যবস্থা নেওয়া হয়। ৯৮ ডিগ্রি ফারেনহাইটের বেশি তাপমাত্রা পাওয়া গেলে

যাত্রীদের স্ক্রিনিং করা হতো। ২০ জানুয়ারি থেকে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে চীন থেকে আসা যাত্রীদের স্ক্রিনিং করা শুরু হয় আলাদাভাবে। ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে দেশের সব বন্দরে স্ক্রিনিংয়ের ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এক্ষেত্রে যেকোনো পথে বিশ্বের যেকোনো দেশ থেকে আসা সব যাত্রীকেই স্ক্রিনিংয়ের আওতায় নিয়ে আসার সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়।

বিজ্ঞাপন

প্রথম নমুনা পরীক্ষা

দেশে নভেল করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) সংক্রমণ শনাক্ত করতে প্রথম নমুনা পরীক্ষা করা হয় ২১ জানুয়ারি। চীনের চীনের উহান থেকে আসা একই পরিবারের দুই সদস্য বিমানবন্দরে অবতরণের পর তাদের একজনের শরীরের তাপমাত্রা ১০১ ডিগ্রি ফারেনহাইট পাওয়া যায়। পরে প্যান-করোনা পদ্ধতিতে তাদের দু’জনের নমুনা পরীক্ষা করে স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও রোগ গবেষণা কেন্দ্র (আইইডিসিআর)। সেটিই ছিল দেশে প্রথম করোনা পরীক্ষা। ২২ জানুয়ারি তাদের নমুনা পরীক্ষার ফল নেগেটিভ আসে। প্যান-করোনা পদ্ধতিতে সময় বেশি লাগে বলে পরে আর আরটি-পিসিআর পদ্ধতিতে করোনা পরীক্ষা শুরু হয় দেশে।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের সংবাদ সম্মেলন

দেশে নভেল করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) পরিস্থিতির তথ্য সবাইকে জানাতে ২৩ জানুয়ারি প্রথম সংবাদ সম্মেলন করে স্বাস্থ্য অধিদফতর। সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন অধিদফতরের কমিউনিকেবল ডিজিজ কন্ট্রোল (সিডিসি) শাখার সাবেক পরিচালক ও অধিদফতরের ওই সময়কার অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. সানিয়া তাহমিনা। তিনি জানান, করোনা পরীক্ষার জন্য পর্যাপ্ত রি-এজেন্টের মজুত আছে। কেউ এই ভাইরাসে আক্রান্ত হলে চিকিৎসার জন্য কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল প্রস্তুত রাখা হয়েছে। প্রথম দিকে কেবল আইইডিসিআরে পরীক্ষা করা হলেও সংক্রমণ বাড়তে থাকায় এপ্রিলের শুরুতে ল্যাবের সংখ্যা বাড়ানো হয়।

বিজ্ঞাপন

সমন্বয়হীনতা

চীনে নভেল করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার পরে সেখানে থাকা বাংলাদেশের নাগরিকদের দেশে ফেরত আনা বিষয়ে সমন্বয়হীনতা প্রকাশ পায়। ২৮ জানুয়ারি স্বাস্থ্যমন্ত্রী এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, চীনের কর্তৃপক্ষ ১৪ দিনের আগে তাদের ছাড়তে রাজি হয়নি। সুতরাং ৬ ফেব্রুয়ারির আগে চীনের উহানে আটকে পড়া কোনো বাংলাদেশি ফিরতে পারবে না।

ওই দিনই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে জরুরি সভা করে। ৩০ জানুয়ারি জানানো হয়, চীনের উহান অঞ্চল থেকে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। ৩১ জানুয়ারি জানানো হয়, ১ ফেব্রুয়ারি চীনের হুবেই শহর থেকে দেশে আনা হচ্ছে ৩৬১ জন বাংলাদেশিকে। দেশে আসার পরে ১৪ দিন নিবিড় পর্যবেক্ষণের জন্য তাদের আশাকোনার হজ ক্যাম্পে স্থাপিত ‘আইসোলেশন ইউনিটে’ রাখা হবে।

পরে ১ ফেব্রুযারি বাংলাদেশিদের ফিরিয়ে নিয়ে আসা সেই ফ্লাইটের আগে ২৬ জন চীনা নাগরিক বিমানবন্দরে প্রবেশ করেন। শরীরে জ্বর বা অন্যান্য কোনো উপসর্গ না থাকায় হেলথ ডিক্লেয়ারেশন কার্ড দেওয়া হয়নি তাদের। একইসঙ্গে তাদের আশকোনায় না পাঠানোর সিদ্ধান্তও হয়। ওই দিন বিশেষ বিমানে করে ৩১২ জন বাংলাদেশি ফিরে আসেন। তাদের কোয়ারেনটাইনের জন্য আশকোনাতে পাঠানো হয়।

৬ ফেব্রুয়ারি স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, দেশের সব মানুষকে মাস্ক পরে বাইরে ঘোরার প্রয়োজন নেই। শুধু তারাই মাস্ক ব্যবহার করবেন, যাদের সর্দি-কাশি ও জ্বর আছে। এক সপ্তাহ পর ১৩ ফেব্রুয়ারি তিনি বলেন, চীন থেকে বাংলাদেশি আর কাউকে দেশে আনা হবে কি না, এর সিদ্ধান্ত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের, এটা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিষয় নয়। ৯ মার্চ তিনি বলেন, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া দেশগুলোতে ফ্লাইট বন্ধের কোনো পরিকল্পনা নেই।

১৪ মার্চ স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, নভেল করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) আক্রান্ত ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলো থেকে যারাই আসছেন তাদের সবাইকে কোয়ারেনটাইনে থাকতে হবে। কিন্তু ওই দিন ইতালি থেকে আসা ১৪২ জন যাত্রীর কোয়ারেনটাইন নিয়ে সমন্বয়হীনতা দেখা দেয়। যাত্রীরা অব্যবস্থাপনার অভিযোগ তুলে কোয়ারেনটাইন পালন করতে অপারগতা প্রকাশ করেন। করোনামুক্ত সনদ থাকায় কোয়ারেনটাইন প্রয়োজন নেই জানিয়ে পরে আবার তাদের কোয়ারেনটাইনে পাঠানো হয়।

১৭ মার্চ স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, বিশ্বে ১৭০টি দেশ করোনাভাইরাস আক্রান্ত। এই দেশগুলো থেকে আগতদের অনেকে বিমানবন্দরে প্রাথমিক চিকিৎসা না নিয়ে ফাঁকি দিয়ে চলে গেছে।

প্রথম সংক্রমণ

২১ জানুয়ারি দেশে নমুনা পরীক্ষা শুরু হলেও প্রথম করোনা সংক্রমণ শনাক্ত হয় ৮ মার্চ। ওই দিন সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, দেশে তিন জনের শরীরে এই ভাইরাসের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। তিন জনের মধ্যে দু’জন ইতালি থেকে ফিরেছেন, আরেকজন তাদেরই একজন পরিবারের সদস্য।

বৈশ্বিক মহামারি ঘোষণা

বিশ্বের ১১০টি দেশে এক লাখ ১৮ হাজার কোভিড-১৯ সংক্রমিত ব্যক্তি শনাক্ত হওয়ার পর ১১ মার্চ করোনাভাইরাসকে বৈশ্বিক মহামারি (প্যানডেমিক) ঘোষণা করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। ওই দিনই দেশে প্রথম করোনা আক্রান্ত তিন জনের মধ্যে দু’জনের নমুনা পরীক্ষায় নেগেটিভ ফল পাওয়া যায়।

করোনা প্রতিরোধে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে প্রথম টাকা বরাদ্দ

৫ মার্চ করোনাভাইরাস মোকাবিলায় বরাদ্দ চেয়ে অর্থ বিভাগকে চিঠি দেয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। তাদের চাহিদা ছিল ১০০ কোটি টাকা। ১১ মার্চ করোনাভাইরাস প্রতিরোধে স্বাস্থ্য অধিদফতরকে ৫০ কোটি টাকা অর্থ বরাদ্দ দেয় অর্থ বিভাগ। বলা হয়, এ টাকা কোভিড-১৯ ছাড়া অন্য কোনো খাতে ব্যয় করা যাবে না।

করোনায় প্রথম মৃত্যু

করেনা সংক্রমণ নিয়ে দেশে প্রথম মৃত্যুর তথ্য জানানো হয় ১৮ মার্চের স্বাস্থ্য অধিদফতরের ব্রিফিংয়ে। ওই ব্রিফিংয়ে অধ্যাপক ডা. মীরজাদি সেব্রিনা ফ্লোরা জানান, যে ব্যক্তি মারা গেছেন তিনি সত্তরোর্ধ্ব। তার শ্বাসকষ্ট (সিওপিডি) ছাড়াও হৃদরোগ ও কিডনিজনিত সমস্যা ছিল। তিনি স্থানীয়ভাবে আক্রান্ত হয়েছিলেন।

প্রথমলকডাউন

১৯ মার্চ স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক জানান, জেলা হিসেবে মাদারীপুর ও জেলাটির শিবচর উপজেলা করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকিতে বেশি রয়েছে। প্রয়োজনে শিবচর ও মাদারীপুর ‘লকডাউন’ করা হতে পারে।

কমিউনিটি ট্রান্সমিশনের ঘোষণা

২৫ মার্চ স্বাস্থ্য অধিদফতরের ব্রিফিংয়ে জানানো হয়, বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ পুরোপুরি কমিউনিটি ট্রান্সমিশন পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়েনি। তবে সীমিত আকারে কমিউনিটি ট্রান্সমিশন হয়ে থাকতে

পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। পরে ১ এপ্রিল দেশে সামান্য মাত্রায় করোনাভাইরাসের কমিউনিটি ট্রান্সমিশন হশুরু হয়েছে বলে জানান জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের (আইপিএইচ) ভাইরোলজিস্ট খন্দকার মাহবুবা জামিল। আর ১৩ এপ্রিল স্বাস্থ্যমন্ত্রী জানান, দেশে কমিউনিটি পর্যায়ে করোনাভাইরাসের ট্রান্সমিশন শুরু হয়েছে।

সাধারণ ছুটি ঘোষণা

২৩ মার্চ সচিবালয়ে জরুরি এক সংবাদ সম্মেলনে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম সাধারণ ছুটির ঘোষণা দেন। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে ওই সময় ২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত ১০ দিন সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়। সাধারণ ছুটির আওতায় সরকারি-বেসরকারি সব ধরনের অফিস বন্ধ থাকলেও কাঁচাবাজার, খাবার ও ওষুধের দোকান, হাসপাতাল এবং জরুরি সেবা এই সাধারণ ছুটির আওতার বাইরে থাকবে বলে জানানো হয়।

হটস্পট নারায়ণগঞ্জ

৯ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ থেকে দেশের বিভিন্ন জেলায় করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ায় এই জেলাকে করোনাভাইরাসের ‘হটস্পট’ হিসেবে চিহ্নিত করে আইইডিসিআর। ওই দিন ব্রিফিংয়ে অধ্যাপক ডা. মীরজাদি সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, দেশের বিভিন্ন জেলায় বিভিন্ন জেলায় এখন কোভিড-১৯ রোগী শনাক্ত হচ্ছে। এর অর্থ সংক্রমণ ছড়াচ্ছে। আমরা এখন লক্ষ করছি, বিভিন্ন জেলায় নতুনভাবে যাদের মাঝে সংক্রমণ পাওয়া যাচ্ছে, তাদের অনেকেই ক্লাস্টারভুক্ত এলাকা থেকে গিয়েছেন। অনেকগুলো জেলায় যখন রোগীর সঙ্গে কথা হয়েছে, তখন তারা বলেছেন যে নারায়ণগঞ্জ থেকে গিয়েছেন। তাই নারায়ণগঞ্জ জেলাকে করোনাভাইরাসের জন্য হটস্পট হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। নারায়ণগঞ্জকে অন্য সব জেলা থেকে আলাদা করা হয়েছে।

প্রথম চিকিৎসকের মৃত্যু

দেশে নভেল করোণাভাইরাস সংক্রমণ শুরুর পরে ৫ এপ্রিল সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক (মেডিসিন) ডা. মঈন উদ্দিনের শরীরে করোনা সংক্রমণ শনাক্ত হয়। ৭ এপ্রিল তার শ্বাসকষ্ট শুরু হলে প্রথমে তাকে সিলেটে শহীদ শামসুদ্দিন আহমদ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ৮ এপ্রিল সেখান

থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকার কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ১৫ এপ্রিল সকাল পৌনে ৮টার দিকে সেখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।

সারাদেশকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা

১৬ এপ্রিল স্বাস্থ্য অধিদফতরের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ দেশের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ায় সারাদেশকে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা ঘোষণা করেছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। এ অবস্থায় জনগণকে ঘরে

থাকা নিশ্চিত ও এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় যানচলাচল নিয়ন্ত্রণ করতে এবং সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ঘরের বাইরে বের না হতে নির্দেশ দেওয়া হয়। সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইনের ১১ (১) ধারার ক্ষমতাবলে গোটা বাংলাদেশকে করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা ঘোষণা করা হয়।

প্রথম বেসরকারি কোভিড১৯ পিসিআর ল্যাব গাজী গ্রুপের

দেশে প্রথমবারের মতো কোভিড-১৯ পরীক্ষার জন্য বেসরকারিভাবে আরটি-পিসিআর ল্যাব স্থাপন করেন বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী বীরপ্রতীক। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে অবস্থিত ইউএস-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ওই ল্যাব স্থাপন করা হয়। ২৯ এপ্রিল ল্যাবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী (বীরপ্রতীক)। ভার্চুয়াল সভা সঞ্চালনা করেন গাজী গ্রুপের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক গাজী গোলাম মর্তুজা। দেশের জন্য এগিয়ে এসে বেসরকারিভাবে ল্যাব স্থাপনের জন্য এদিন গাজী গ্রুপকে ধন্যবাদ জানান স্বাস্থ্যমন্ত্রী। পরে দেশের বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকেই করোনা পরীক্ষার অনুমোদন দেওয়া হয়।

পরামর্শক কমিটি গঠন

গত ১৯ এপ্রিল ১৭ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসককে নিয়ে গঠন করা হয় জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটি। কমিটিতে সভাপতি করা হয় বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের সভাপতি শিশু বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মোহাম্মদ শহীদুল্লাহকে। সদস্য সচিব করা হয় আইইডিসিআর পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরাকে।

জিনোম সিকুয়েন্স

দেশে প্রথম প্রতিষ্ঠান হিসেবে ১১ মে জিআইএসএইড-এর কাছে জিনোম সিকুয়েন্স জমা দেয় চাইল্ড হেলথ রিসার্চ ফাউন্ডেশন (সিএইচআরএফ)। পরে বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ (বিসিএসআইআর), চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও অ্যানিমেল সাইন্সেস বিশ্ববিদ্যালয় (সিভাসু), চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানই করোনা নমুনার জিনোম সিকুয়েন্স করেছে।

গ্লোব বায়োটেকের ভ্যাকসিন তৈরির ঘোষণা

করোনাভাইরাস ঠেকাতে ভ্যাকসিন তৈরির জন্য যখন সারাবিশ্ব উঠেপড়ে লেগেছিল, তখন ১ জুলাই বাংলাদেশেই করোনার ভ্যাকসিন উদ্ভাবনের দাবি জানিয়ে গণমাধ্যমে প্রেস বিজ্ঞপ্তি পাঠায় গ্লোব বায়োটেক। পরদিন ২ জুলাই এক সংবাদ সম্মেলনে প্রতিষ্ঠানটি জানায়, প্রথম অ্যানিমেল ট্রায়ালে তাদের ভ্যাকসিন সফল হয়েছে। পরে দ্বিতীয় অ্যানিমেল ট্রায়ালে সাফল্য দাবি করে হিউম্যান তথা ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে যাওয়ার ঘোষণা দেয় গ্লোব। তবে এখন পর্যন্ত ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে যাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি তারা সম্পন্ন করতে পারেনি। তাদের আগের দুই পরীক্ষার ফলও কোনো স্বীকৃত জার্নালে প্রকাশ পায়নি।

অ্যান্টিজেন পরীক্ষা

করোনা পরীক্ষার আওতা ও গতি বাড়াতে শুরু থেকেই আরটি-পিসিআর পরীক্ষার পাশাপাশি করোনা পরীক্ষার বিকল্প পদ্ধতি চালুর তাগাদা দিয়ে আসছিলেন বিশেষজ্ঞরা। শেষ পর্যন্ত গত ৫ ডিসেম্বর থেকে দেশের ১০টি জেলা শহরে র‍্যাপিড অ্যান্টিবডি পরীক্ষা শুরু করা হয়। বর্তমানে ৪০টি ল্যাবে র‌্যাপিড অ্যান্টিজেন পদ্ধতিতে করোনা পরীক্ষা চলছে। যদিও এই পদ্ধতিতে এখন পর্যন্ত তেমন সাড়া মেলেনি।

ভ্যাকসিন পেতে সমঝোতা চুক্তি সই

৫ নভেম্বর সচিবালয়ে করোনাভাইরাস মোকাবিলায় যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির তৈরি তিন কোটি ডোজ ভ্যাকসিন পেতে একটি সমঝোতা স্মারক (এমইউ) সই করে বাংলাদেশ সরকার। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের উপস্থিতিতে সমঝোতা চুক্তি সই করে বেসরকারি কোম্পানি বেক্সিমকো ফার্মা ও ভারতের কোম্পানি সিরাম ইনস্টিটিউট। চুক্তি অনুযায়ী, অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার যে ভ্যাকসিন ভারতের সিরাম উৎপাদন করবে, তার তিন কোটি ডোজ তাদের কাছ থেকে আমদানি করবে বেক্সিমকো। পরে জানানো হয়, ছয় মাসে ৫০ লাখ ডোজ করে ভ্যাকসিন আসবে দেশে।

ভ্যাকসিন প্রয়োগের রূপরেখা

ভ্যাকসিন কেনার জন্য ৭৩৫ কোটি ৭৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ করেছে সরকার। সরকার বেক্সিমকোর মাধ্যমে যেসব ভ্যাকসিন আনছে, সেগুলো বিনামূল্যে দেওয়ার কথা রয়েছে সবাইকে। সরকার জানিয়েছে, শুরুতে টিকা পাবেন করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে থাকা সম্মুখভাগের যোদ্ধারা।

গণপরিবহন চলাচল

দেশে ২৬ মার্চ থেকে সাধারণ ছুটি কার্যকর করা হয়। এরপর দফায় দফায় বাড়তে থাকে সাধারণ ছুটির মেয়াদ। সাধারণ ছুটির আওতায় গণপরিবহন চলাচলও বন্ধ ছিল। ৬৬ দিন পর ৩০ মে দেশে অফিস খোলার পাশাপাশি গণপরিবহন চলাচলের অনুমতি দেয় সরকার। মার্চের শেষ সপ্তাহ থেকে বন্ধ ছিল অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ফ্লাইটও। পরে ১ জুন থেকে শুরু হয় অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট চলাচল। ১৬ জুন চালু হয় আন্তর্জাতিক ফ্লাইট।

স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি

বছরজুড়ে স্বাস্থ্য খাতের নানা দুর্নীতি ছিল অন্যতম আলোচিত বিষয়। শুরুতেই আলোচনায় আসে চিকিৎসকদের পিপিই সংকটের বিষয়টি। নিম্ন মানের পিপিই নিয়ে আলোচনায় আসে কেন্দ্রীয় ঔষধাগার (সিএমএসডি)। এছাড়াও নমুনা পরীক্ষায় অনিয়ম, ভুল রিপোর্ট ও জালিয়াতির অভিযোগ ওঠে জেকেজি হেলথকেয়ার ও রিজেন্ট হাসপাতালের বিরুদ্ধে। পরে এই দুই প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তারা গ্রেফতার হন। তারা বর্তমানে বিচারাধীন রয়েছেন।

এদিকে, করোনা মোকাবিলায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ‘ইমার্জেন্সি রেসপন্স প্যানডেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস (ইআরপিপি)’ প্রকল্পের আওতায় বাজারদরের তুলনায় দ্বিগুণ-তিন গুণ দামে সুরক্ষা সরঞ্জাম সরবরাহ, নিম্ন মানের পণ্য সরবরাহ, সঠিক সময়ে পণ্য সরবরাহ না করা, চুক্তির তুলনায় কম পরিমাণ পণ্য সরবরাহের মতো নানা ধরনের অভিযোগ উঠতে থাকে। এসব বিষয় নিয়ে গণমাধ্যমগুলোতে খবর প্রকাশ হলে অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে বেশকিছু প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত এসব তদন্তের কোনো ফল দৃশ্যমান হয়নি।

এ বছরই স্বাস্থ্য অধিদফতরের নানা দুর্নীতির চিত্র বেরিয়ে আসার মধ্যে প্রতিষ্ঠানটির অফিস সহকরী আবজাল হোসেনেরও বিপুল সম্পদের তথ্য পায় দুদক। তাকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে দুদকের মামলায়।

ড্রাইভারমালেককাণ্ড

অবৈধ অস্ত্র ও জাল টাকার কারবারে জড়িত থাকার তথ্য পেয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের স্বাস্থ্য শিক্ষা বিভাগের মহাপরিচালকের গাড়িচালক আব্দুল মালেককে গ্রেফতার করে র‌্যাব। জানা যায়, আব্দুল মালেকের তুরাগের দক্ষিণ কামারপাড়ায় দুইটি সাত তলা ভবন, একই এলাকায় একটি বিশাল ডেইরি ফার্ম, ধানমন্ডির হাতিরপুলে সাড়ে ৪

কাঠা জমিতে একটি নির্মাণাধীন ১০তলা ভবন ছাড়াও কলাবাগানসহ রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে অন্তত ১৫টি ফ্ল্যাট রয়েছে তার। এছাড়া বিভিন্ন ব্যাংকে বিপুল পরিমাণ অর্থ থাকার প্রমাণও পাওয়া যায়।

শীর্ষ পদগুলোতে পরিবর্তন

দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগ যখন তুঙ্গে, এর মধ্যেই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদফতরসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর শীর্ষ বেশকিছু পদে আসে রদবদল। স্বাস্থ্য সচিব আসাদুল ইসলামকে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে বদলি করে এই পদে নিয়ে আসা হয় ভূমি মন্ত্রণালয়ের সচিব আব্দুল মান্নানকে। অন্যদিকে, নানাবিধ বিতর্কের মুখে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক পদ থেকে পদত্যাগ করে অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ। তার স্থলাভিষিক্ত হন অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশিদ আলম।

এদিকে, ইআরপিপি প্রকল্প পরিচালক ইকবাল কবীরের জায়গায় দায়িত্ব পান ডা. শামীম হোসেন। পরে তাকেও পরিবর্তন করলে বর্তমানে এই দায়িত্ব পালন করছেন ডা. আজিজুর রহমান। সিএমএসডি’র পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শহিদুল্লাহকে সেনাবাহিনীতে ফিরিয়ে নেওয়া হয়। এই পদে বর্তমানে দায়িত্ব পালন করছেন আবু হেনা মোর্শেদ জামান। স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (হাসপাতাল) ডা. আমিনুল ইসলামকে ওএসডি করলে এই পদে এখন রয়েছেন ডা. ফরিদ মিয়া। এছাড়া স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা ও গবেষণা) ডা. সানিয়া তাহমিনা অবসরে গেলে এই পদে নিয়োগ পান আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা। আর আইইডিসিআরের পরিচালন হিসেবে নিয়োগ পান ডা. তাহমিনা শিরীন।

ভ্যাকসিন আশাবাদ

বিশ্বকে নাড়িয়ে দেওয়া ভাইরাসটি ২০২০ সাল ধরে তাণ্ডব চালিয়ে গেলেও বিদায়ী বছর শেষ করে নতুন বছরের যাত্রার শুরুটা শেষ পর্যন্ত হচ্ছে আশাবাদে। কার্যকারিতা নিয়ে সম্পূর্ণ নিঃসন্দেহ হওয়া না গেলেও এখন পর্যন্ত চারটি কোম্পানির করোনা ভ্যাকসিনের প্রয়োগ শুরু হয়েছে বিশ্বের কয়েকটি দেশে। সরকার আশা করছে, ফেব্রুয়ারি নাগাদ ভ্যাকসিন পাবে বাংলাদেশও। এই ভ্যাকসিনের কার্যকারিতার ওপরই নির্ভর করছে কেমন যাবে নতুন বছর ২০২১।

সারাবাংলা/এসবি/টিআর

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন