বিজ্ঞাপন

বিদ্যুৎকেন্দ্রে শ্রমিক বিক্ষোভে ইন্ধন দেখছে প্রশাসন!

April 17, 2021 | 9:45 pm

রমেন দাশ গুপ্ত, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

চট্টগ্রাম ব্যুরো: চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে নির্মাণাধীন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে শ্রমিকদের হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে রক্তক্ষয়ী সংঘাতে জড়িয়ে পড়ার পেছনে স্থানীয় ‘স্বার্থান্বেষী’ মহলের ইন্ধন আছে বলে মনে করছে প্রশাসন। এ পরিপ্রেক্ষিতে উসকানিদাতাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনার ঘোষণা দিয়েছেন পুলিশ সুপার ও জেলা প্রশাসক। তারা জানিয়েছেন, শ্রমিকদের অধিকাংশ দাবিই বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ মেনে নিলেও তারা আকস্মিকভাবে বিক্ষুব্ধ হয়ে চীনের নাগরিক ও পুলিশের ওপর আক্রমণ করে এবং যানবাহনে আগুন দেয়। এতে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়।

বিজ্ঞাপন

তবে বিদ্যুৎকেন্দ্রের শ্রমিকরা জানিয়েছেন, ১২ দফা দাবিতে তারা আন্দোলন করে আসছিলেন। কিন্তু কোনো দাবিই কর্তৃপক্ষ মেনে নেয়নি। এ অবস্থায় শনিবার (১৭ এপ্রিল) ঐক্যবদ্ধভাবে তারা কাজে যোগদান থেকে বিরত থাকেন এবং আন্দোলন শুরু করেন। পুলিশ তাদের কয়েকজন শ্রমিককে ধরে ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়ায় উত্তেজনার সৃষ্টি হয়।

শনিবার বাঁশখালী উপজেলার গণ্ডামারা ইউনিয়নের পূর্ব বড়ঘোনা এলাকায় নির্মাণাধীন ১৩২০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের শ্রমিকদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়। এতে পুলিশের গুলিতে অন্তত পাঁচ শ্রমিক নিহত হন। আহত হয়েছেন আরও কমপক্ষে ২০-২১ জন, যাদের মধ্যে পুলিশ ও শ্রমিক আছেন।

নিহতরা হলেন- কিশোরগঞ্জের ফারুক আহমদের ছেলে মাহমুদ হাসান রাহাত (২২), চুয়াডাঙ্গার অলিউল্লাহর ছেলে মো. রনি হোসেন (২৩), নোয়াখালীর আব্দুল মতিনের ছেলে মো. রায়হান (১৯), চাঁদপুরের মো. নজরুলের ছেলে মো. শুভ (২২) এবং বাঁশখালীর পূর্ব বড়ঘোনার আবু ছিদ্দিকির ছেলে মাহমুদ রেজা (১৯)।

বিজ্ঞাপন

আহতদের মধ্যে তিন পুলিশসহ ১৯ জনকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এদের মধ্যে অন্তত পাঁচজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানিয়েছেন চমেক হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক আনোয়ারুল হক।

আনোয়ারুল হক বলেন, ‘আমাদের ওয়ার্ডে ১৩ জনকে ভর্তি করা হয়েছে। এর মধ্যে পাঁচজনের অবস্থা গুরুতর। সবাই গুলি বা স্প্লিন্টারে বিদ্ধ। তবে তা শর্টগান না কিসের গুলি, এখনই বলা সম্ভব নয়।’

চমেক হাসপাতাল চিকিৎসাধীন আহত শ্রমিকেরা হলেন- আমিনুল ইসলাম (২৫), মো. আমির (২৪), মো. দিদার (২১), মো. বিল্লাল (২৬), মো. আযাদ (১৮), মো. কামরুল (২৬), শিমুল (২৮), শাকিল (২৩), মোরাদ (২৫), মিজান (১৮), রাহাত (২৮), হাবিবুল্লাহ (১৮), হাসান (৪০) ও অভি (২০)। একই হাসপাতাল ভর্তি আহত পুলিশ সদস্যরা হলেন মো. ইয়াসির (২৪), আহমদ কবির (২৬) ও আসদুজ্জামান। তিনজনই গন্ডামারা পুলিশ ফাঁড়িতে কর্মরত।

বিজ্ঞাপন

চমেক পুলিশ ফাঁড়ির কর্তব্যরত উপপরিদর্শক (এসআই) শীলাব্রত বড়ুয়া জানিয়েছেন, গুলিবিদ্ধ অবস্থায় শ্রমিকদের হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। আর পুলিশ সদস্যরা ইট-পাথরের আঘাতে জখম হয়েছেন।

আলোচিত শিল্প প্রতিষ্ঠান এস আলম গ্রুপ এবং চীনের একটি কোম্পানি যৌথভাবে এই বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করছে। ২০১৬ সালে এই বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের বিরোধিতা করে স্থানীয়দের আন্দোলনের সময় ‍পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে অন্তত ছয়জন নিহত হয়। সেসময় ওই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন স্থানীয় বিএনপি নেতা ও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান লিয়াকত আলী। পাঁচ বছর পর শ্রমিকদের আরেকদফা রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে জড়ানোর ক্ষেত্রেও স্থানীয়দের ইন্ধন আছে বলে মনে করছেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা।

ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার এস এম রাশিদুল হক সাংবাদিকদের বলেন, ‘শ্রমিকদের কিছু দাবিদাওয়া ছিল বেতন বাড়ানোসহ। এগুলো নিয়ে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা চলছিল। গতকালই (শুক্রবার) কিন্তু আলোচনা করে নিষ্পত্তি হয়েছে। অধিকাংশ দাবিদাওয়া কিন্তু কর্তৃপক্ষ মেনে নিয়েছে। আর দুয়েকটি বিষয় ছিল যেগুলো নিয়ে আজ (শনিবার) আলোচনা করার কথা ছিল। খুব ছোটখাট বিষয় ছিল সেগুলো।’

বিজ্ঞাপন

এরপরও শ্রমিকরা বিক্ষোভ শুরুর ক্ষেত্রে ইন্ধনের ধারণা করে এসপি বলেন, ‘দাবি মেনে নেয়ার পরও আজ সকাল থেকে আশপাশের কিছু লোকের ইন্ধনে, ইচ্ছাকৃত ইন্ধনে, পরিস্থিতিকে অস্থিতিশীল করার জন্য স্থানীয় যেসব শ্রমিক কাজ করে তারা একযোগে, এখানে যেসব চীনের শ্রমিক কাজ করে তাদের ওপর আক্রমণের চেষ্টা করে। আমাদের পুলিশ সদস্যদের ওপর আক্রমণ হয়েছে। ঢালাইয়ের গাড়ি, প্রাইভেটকার, মোটরসাইকেলে আগুন দেওয়া হয়েছে। একপর্যায়ে জানমাল রক্ষার্থে, এই প্ল্যান্টের সম্পত্তি রক্ষার্থে, চীনের নাগরিকদের জানমাল রক্ষার্থে পুলিশ এখানে আইনগত যা যা ব্যবস্থা নেওয়ার তা নিয়েছে। এখন তদন্ত করে মামলাসহ পরবর্তী আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মো. মোমিনুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, ‘স্থানীয় কিছু স্বার্থান্বেষী মহল উসকানি দিয়ে এ ঘটনা ঘটিয়েছে। এদেশের অগ্রগতি-উন্নয়ন অনেকের চক্ষুশূল। আমাদের কাছে সিসিটিভি ফুটেজ আছে, তথ্যপ্রমাণ আছে। তদন্ত হচ্ছে। যারা যারা জড়িত তাদের প্রত্যেককে আইনের আওতায় আনা হবে। ক্ষয়ক্ষতি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।’

পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি আনোয়ার হোসেন সারাবাংলাকে জানিয়েছেন, সংঘর্ষের ঘটনা তদন্তে অতিরিক্ত ডিআইজি জাকির হোসেনকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি কমিটি করা হয়েছে। তাদের সাত কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।

জেলা প্রশাসক মোমিনুর রহমান জানান, জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে চার সদস্যের একটি কমিটি করা হয়েছে। একজন অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে একজন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, শিল্প মন্ত্রণালয় ও বিদ্যুৎ বিভাগের প্রতিনিধি এই কমিটিতে থাকবেন। কমিটি সাত কার্যদিবসের মধ্যে কি কারণে ঘটনাটি ঘটেছে সেগুলো উল্লেখ করে এবং আগামীতে এ ধরনের ঘটনা যাতে না ঘটে সে বিষয়ে সুপারিশ করে প্রতিবেদন দেবে।

এদিকে সংঘর্ষে নিহতদের প্রত্যেকের পরিবারকে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তিন লাখ টাকা করে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন জেলা প্রশাসক। এছাড়া আহতদের সুচিকিৎসার ব্যবস্থা ও ৫০ হাজার টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে জানিয়েছেন তিনি।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চীনের ৬৩০ জন শ্রমিকের পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা ১০ থেকে ১৫ হাজার শ্রমিক কাজ করে ওই বিদ্যুৎকেন্দ্রে। তবে আশপাশের এলাকার শ্রমিক সবচেয়ে বেশি। এসব শ্রমিকদের ১৫ জন মাঝি আছে। যারা শ্রমিক সরবরাহের জন্য বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ। শ্রমিকদের বেতন ঘণ্টাপ্রতি ৫০ টাকা থেকে ৮০ টাকা।

শ্রমিকদের অভিযোগ, রমজানে আট ঘণ্টা কাজের জন্য ১০ ঘণ্টার মজুরি দেওয়ার দাবি করে আসছিলেন তারা। এছাড়া থাকা ও নামাজের সুব্যবস্থা করাসহ মোট ১২ দফা দাবি তাদের ছিল। কিন্তু কর্তৃপক্ষ তাদের দাবি মেনে নেয়নি। এমনকি দাবির প্রতি ন্যূনতম কর্ণপাতও করেনি। ফলে বাংলাদেশি শ্রমিকরা ঐক্যবদ্ধভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে শনিবার সকালে কাজে যোগদান থেকে বিরত থাকেন। এক পর্যায়ে পুলিশ ১৫ জন শ্রমিককে ধরে ক্যাম্পে নিয়ে যায়। এরপর আরও কয়েকজনকে ধরে ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে শ্রমিকরা উত্তেজিত হয়ে ওঠে এবং সংঘর্ষ শুরু হয়।

পুলিশ সূত্র ও স্থানীয়রা জানিয়েছেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ প্রথমে লাঠিচার্জ এবং পরে কাঁদানে গ্যাস ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে। এরপরও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না আসা পুলিশ শটগানের গুলি ছোঁড়ে। এরপর শ্রমিকরা বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিভিন্ন স্থাপনায় আগুন লাগিয়ে দেয়। এতে সাতটি মিক্সার গাড়ি ও শীততাপ নিয়ন্ত্রক যন্ত্র পুড়ে যায়। পরে অতিরিক্ত পুলিশ, র‌্যাব ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।

সংঘর্ষের পর বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বাংলাদেশি শ্রমিকদের প্রায় সবাই চলে যান। সেখানে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন পুলিশ সুপার রাশিদুল হক।

এদিকে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) চট্টগ্রাম জেলার ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আবদুল নবী ও সাধারণ সম্পাদক অশোক সাহা পুলিশের গুলিতে পাঁচ শ্রমিক নিহতের ঘটনার নিন্দা জানিয়েছেন এবং এর সঙ্গে জড়িতদের বিচার দাবি করেছেন।

কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে বিক্ষোভরত শ্রমিকদের ওপর হামলার নিন্দা জানিয়েছেন বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র চট্টগ্রাম জেলা কমিটির সভাপতি তপন দত্ত, যুগ্ম সম্পাদক ইফতেখার কামাল খান, পাহাড়তলী আঞ্চলিক কমিটির সভাপতি মির মোহাম্মদ ইলিয়াছ এবং সাধারণ সম্পাদক সুকান্ত দত্ত।

ছাত্র ইউনিয়ন চট্টগ্রাম জেলার সভাপতি অ্যানি সেন ও সাধারণ সম্পাদক ইমরান চৌধুরী এক বিবৃতিতে ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের বিচারের পাশাপাশি এস আলম গ্রুপের পরিবেশ বিধ্বংসী এই বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধের দাবি জানিয়েছেন।

আরও পড়ুন-

বাঁশখালীতে পুলিশের গুলিতে নিহত শ্রমিকের সংখ্যা বেড়ে ৫

বেতনের দাবিতে রাস্তায় নেমে পুলিশের গুলিতে ৪ শ্রমিক নিহত

 

সারাবাংলা/আরডি/পিটিএম

Tags: , , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন