বিজ্ঞাপন

যুক্তরাষ্ট্র নয় বদলে যাওয়া পাকিস্তানের চাহিদা মেটাচ্ছে চীন

May 26, 2021 | 7:23 pm

সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র সফর করেছেন পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মেহমুদ কোরেশি। ইমরান খান সরকারের দ্বিতীয় ক্ষমতাধর ব্যক্তি হিসেবে মনে করা হয় তাকে। দেশটির পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসেবেও অনেকেই তার নাম আলোচনায় রাখেন। মেহমুদ কোরেশির মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফরকালে তার সাক্ষাৎকার নিয়েছে নিক্কেই এশিয়া। সাক্ষাৎকারে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সঙ্গে পাকিস্তানের বর্তমান সম্পর্কের নানা দিক উঠে এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে কৌশলগত জোট কোয়াড, পাকিস্তানে চীনের নৌঘাঁটি নির্মাণের সম্ভাব্যতা, ভবিষ্যতে আমেরিকার সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক— এমন বিভিন্ন বিষয় নিয়ে উত্তর দিয়েছেন শাহ মেহমুদ কোরেশি। সাক্ষাৎকারটি সাংরাবাংলার পাঠকদের জন্য ভাষান্তরিত করে প্রকাশ করা হলো। ভাষান্তর করেছেন সারাবাংলার নিউজরুম এডিটর আতিকুল ইসলাম ইমন

বিজ্ঞাপন

নিক্কেই এশিয়া: পাকিস্তান হাতেগোনা সেই কয়েকটি দেশের মধ্যে একটি যে আমেরিকা ও চীনের সঙ্গে দশকের পর দশক ধরে সমানভাবে সম্পর্ক রেখে চলতে পেরেছে। ইসলামাবাদ দীর্ঘদিন ধরে ওয়াশিংটন ও বেইজিংয়ের সঙ্গে সম্পর্কের ভারসাম্য বজায় রেখে চলেছে। কিন্তু এখন আর তেমনটা সম্ভব হচ্ছে না। এখন মনে হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের মাধুর্য শেষ হয়ে গেছে, আর পাকিস্তান অনিচ্ছাসত্ত্বেও চীন শিবিরে যোগ দিয়েছে।

শাহ মেহমুদ কোরেশি: আমরা আমেরিকানদের বলে আসছিলাম— যদি আপনারা চলে যান, তাহলে কাউকে না কাউকে এখানে আসতেই হবে। আপনারা পাকিস্তানে বিনিয়োগ করছেন না, পাকিস্তানের বিভিন্ন ইস্যুর সঙ্গে জড়াচ্ছেন না। এভাবে একটি দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক কিভাবে টিকে থাকবে? দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক টিকে থাকার একটিই রাস্তা— স্বার্থসংশ্লিষ্ট ইস্যুর সঙ্গে যুক্ত হওয়া। তা না করে শুধু লেনদেন নিয়ে পড়ে থাকলে সম্পর্ক বেশিদিন টিকবে না। আমাদের সঙ্গে কথা বলার সময় আপনারা কেবল ‘আফগানিস্তান, আফগানিস্তান’ করতে পারেন না। আফগানিস্তান ছাড়াও আমাদের মধ্যে অন্য দ্বিপাক্ষিক অনেক বিষয়ই রয়েছে।

অবশ্যই আফগানিস্তান গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যা পারছি করছি। দেশটিতে শান্তি-স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে আমাদের পক্ষে যতটুকু সম্ভব, আমরা করব। কিন্তু গত দুই দশক ধরে পাকিস্তানকে যুক্তরাষ্ট্র শুধুই আফগানিস্তানের আয়না দিয়ে দেখে এসেছে। আমাদের সঙ্গে আমেরিকার যত কথাবার্তা হতো, তার সবই ছিল আফগানিস্তান সম্পর্কিত। আমরা বলব, আফগানিস্তানের আয়না দিয়ে আমাদের দেখা বন্ধ করুন। আমাদের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক আরও অনেক বিষয় আছে।

বিজ্ঞাপন

আমেরিকা কি পাকিস্তানে বিনিয়োগ করবে না? আবার চীন যদি আমাদের দেশে বিনিয়োগ করতে চায়, তাহলে কি আমরা তাদের বাধা দেবো? আমাদের বিনিয়োগ প্রয়োজন, প্রযুক্তিগত আদান-প্রদান প্রয়োজন। যুক্তরাষ্ট্র কোনোটিই আমাদের দিচ্ছে না। কিন্তু চীন দিচ্ছে, এবং বহু ক্ষেত্রে ছাড়ও দিচ্ছে। ফলে (সম্পর্কের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র) যেখানে পারছে না, চীন সেখানে পৌঁছে যাচ্ছে। তবে আমরা কোনো শিবিরে যোগ দিতে চাই না। এ ক্ষেত্রে চীন আমাদের অভাব পূরণ করছে। আমরা বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরি করেছি। সেখানে বিনিয়োগে কারও জন্যই বাধা নেই। যুক্তরাষ্ট্র কেন এখানে বিনিয়োগ করছে না? আমরা কি আমেরিকাকে না বলেছি? না, বলিনি।

নিক্কেই এশিয়া: আপনি আমেরিকার সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্কের দ্বিধাদ্বন্দ্বের কথা স্বীকার করেছেন। এটাও জানিয়েছেন, মার্কিন সেক্রেটারি অ্যান্তোনি ব্লিনকেনকে সম্পর্কের যে বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করা সম্ভব, সেগুলো নিয়ে কাজ করতে বলেছেন। দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের মধ্যে কোন বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করা সম্ভব?

শাহ মেহমুদ কোরেশি: স্নায়ুযুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে। ভারতের সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্ক নতুনভাবে গড়ে উঠেছে। কোয়াড গঠন হচ্ছে। তাদের কাছ থেকে আমরা যে সামরিক সহায়তা পেতাম, তা এখন আর পাই না। জোটের সহায়তা তহবিলে আমাদের অর্থ পাওনা আছে, সেটাও দেওয়া হচ্ছে না। সামরিক প্রশিক্ষণ কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে। বৈদেশিক সামরিক অর্থায়ন শেষ হয়ে গেছে।

বিজ্ঞাপন

কিন্তু এরপরও এমন কিছু জায়গা আছে যা নিয়ে আমরা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কাজ করতে পারি। যেমন— অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব, বাণিজ্য, বিনিয়োগ, জলবায়ু। আমরা বিশ্বের ১০টি জলবায়ু প্রভাবিত অঞ্চলের একটি। আফগানিস্তান, এমনকি ভারতের সঙ্গেও এখন শান্তি ও স্থিতিশীলতার ব্যাপারে আমাদের একাত্মতা রয়েছে। ভারতই মূলত শান্তির পথ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, আমরা নই। তথ্যপ্রযুক্তির মতো জায়গা আছে, যেখানে পাকিস্তান ও আমেরিকা একসঙ্গে কাজ করতে পারে। জ্বালানি শক্তি, কৃষি— এসব খাতেও আমরা কাজ করতে পারি। অভিবাসী ইস্যু আছে। এরকম বহু বিষয় আছে যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কাজ করা সম্ভব।

নিক্কেই এশিয়া: আফগানিস্তান শান্তি প্রক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের সহায়ক ছিল পাকিস্তান। যুক্তরাষ্ট্রের সরে যাওয়ায় সহায়তা করেছে পাকিস্তান। এসব প্রক্রিয়া থেকে পাকিস্তান যা চেয়েছিল তা কি পেয়েছে?

শাহ মেহমুদ কোরেশি: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান ছেড়ে গেলেও তাদের কাছে পাকিস্তানের প্রাসঙ্গিকতা থাকবে। আমাদের ভূকৌশলগত অবস্থানটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের জনসংখ্যা ২০ কোটি। আমরা ওআইসি’র গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। আমরা পারমাণবিক শক্তিসম্পন্ন দেশ। পাকিস্তানকে তাদের জন্য প্রয়োজন। তাই পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত থাকাটাই তাদের জন্য ভালো হবে।

নিক্কেই এশিয়া: আফগানিস্তানের সুরক্ষা ও আফগান নিরাপত্তা বাহিনীকে সহায়তা করার জন্য এই অঞ্চলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উপস্থিতি জারি রাখা প্রয়োজন। পাকিস্তান কি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সামরিক ঘাঁটি তৈরি করতে দিতে রাজি হবে?

বিজ্ঞাপন

শাহ মেহমুদ কোরেশি: কৌশলগত দিক থেকে আমাদের স্পষ্ট পরিবর্তন ঘটেছে— আমরা ভূ-রাজনীতি থেকে ভূ-অর্থনীতির দিকে ধাবিত হয়েছি। আমাদের এখন তাৎক্ষণিক অগ্রাধিকার ও প্রয়োজন হলো অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা। ফলে পাকিস্তানে অর্থনৈতিক ঘাঁটি তৈরি করতে চাইলে আমরা সবসময় আমেরিকাকে স্বাগত জানাব।

নিক্কেই এশিয়া: কিন্তু আমেরিকার জন্য পাকিস্তানের সামরিক প্রবেশাধিকার দেওয়ার ইতিহাস পুরনো। সেই পঞ্চাশের দশক থেকে এই শতকের প্রথম দশক পর্যন্ত পাকিস্তান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সামরিক ঘাঁটি গড়ার সুবিধা দিয়ে আসছিল। এখন নয় কেন?

শাহ মেহমুদ কোরেশি: পৃথিবী বদলে গেছে। প্রয়োজনীয়তাতেও বদল এসেছে। বদলে গেছে বন্ধুরাও। আমেরিকার এখন নতুন বন্ধু আছে।

নিক্কেই এশিয়া: পাকিস্তানেরও কি তবে নতুন বন্ধু হয়েছে?

শাহ মেহমুদ কোরেশি: আমাদের পুরনো বন্ধু আছে। আমরা নতুন উদ্দীপনা নিয়ে তাদের সঙ্গে কাজ করছি।

নিক্কেই এশিয়া: পুরনো বন্ধু ও নতুন উদ্দীপনা নিয়ে কথা হচ্ছিল— ২০২০ সালে পেন্টাগনের এক প্রতিবেদনে অনুমান করা হয়েছে যে চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মির নৌবাহিনী পাকিস্তানের বন্দর নগর গোয়াদরে সামরিক ঘাঁটি বানানোর চেষ্টা করছে।

শাহ মেহমুদ কোরেশি: গোয়াদর একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল। আমরা একে একটি অর্থনৈতিক হাব হিসেবে দেখতে চাই। এখানে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড জোরদার হোক— সেটাই চাই। এটি এমন একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল যেখানে আঞ্চলিক বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক করিডোরকে আরও উন্নত ও জোরদার করবে।

নিক্কেই এশিয়া: কিন্তু এরকম প্রতিবেদন আছে যে চীনের নৌবাহিনীর কর্মকর্তারা গোয়াদর সফরে গিয়েছিলেন এবং জিওয়ানির মতো আশপাশের আরও কিছু বন্দরেও তারা গিয়েছিলেন। পাকিস্তান কি ভবিষ্যতে চীনা সামরিক বাহিনীকে ডকিং বা ঘাঁটি স্থাপনের সুবিধা দেওয়ার বিষয়ে বিবেচনা করবে?

শাহ মেহমুদ কোরেশি: চীনের নৌবাহিনীর কোনো ঘাঁটির বিষয়ে আমার কিছু জানা নেই। কিন্তু আপনি ভবিষ্যদ্বাণীও করতে পারেন না। এই মুহূর্তে আমাদের মূল লক্ষ্য অর্থনৈতিক ঘাঁটি তৈরি, আমরা সেদিকেই জোর দিচ্ছি। ভবিষ্যতে কী হবে, তা নিয়ে আমরা পরে ভাবব, ঠিক যেমন আমরা কোয়াড নিয়েও ভাবব। এটি নির্ভর করে কোয়াড কিভাবে গঠিত হচ্ছে তার ওপর।

নিক্কেই এশিয়া: আপনি কি বলতে চাইছেন যে কোয়াড পাকিস্তানকে চিন্তায় ফেলে দিয়েছে? পাকিস্তান কোয়াডকে কিভাবে দেখছে? প্রশংসা নাকি উদ্বেগ নিয়ে দেখছে?

শাহ মেহমুদ কোরেশি: আগ্রহ নিয়ে দেখছে। [অট্টহাসি]

নিক্কেই এশিয়া: আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করার জন্য এখন কি আর কোনো উপায় আছে? যদি থাকে সেগুলো কী?

শাহ মেহমুদ কোরেশি: আমরা তাদের বলেছি যে পাকিস্তানের ভাবনার জায়গায় পরিবর্তন এসেছে। মার্কিন প্রশাসনকে তাদের অতীতের হ্যাংওভার কাটিয়ে উঠতে হবে। এখনকার পাকিস্তান নতুন ও পরিবর্তিত এক পাকিস্তান। এই পাকিস্তানের অগ্রাধিকার বদলে গেছে। এখন আমাদের অগ্রাধিকার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, মানব উন্নয়ন, অর্থনৈতিক নিরাপত্তা, সন্ত্রাসবাদ নির্মূল এবং উগ্রবাদের বিরুদ্ধে কাজ করা।

নিক্কেই এশিয়া: আপনাকে ধন্যবাদ।

শাহ মেহমুদ কোরেশি: আপনাকেও ধন্যবাদ।

সারাবাংলা/আইই/টিআর

Tags: , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন