বিজ্ঞাপন

স্বৈরাচার পতনের পর রাজপথে দেখেছি জনতার বাঁধভাঙা স্রোত

December 6, 2021 | 5:15 pm

আজমল হক হেলাল, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: আজ ৬ ডিসেম্বর, স্বৈরাচার এরশাদ সরকারের পতন দিবস। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ তৎকালীন সেনাপ্রধান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেছিলেন। এরপরই দেশের গণতন্ত্রকে হত্যা করে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ও তার দলীয় লোকদের দিয়ে শুরু করে প্রতিপক্ষের ওপর জেল জুলুম নিপীড়ন, নির্যাতন। একের পর এক শুরু হয় দেশের জনগণের মৌলিক অধিকার হরণ। হরণ করে নেওয়া হয় সাংবাদিকদের অধিকার। স্বৈরশাসকের পতনের পর রাজপথে দেখেছি জনতার বাঁধ ভাঙ্গা স্রোত আর আনন্দ উল্লাস। তবে এর আগে ৯টি বছর তার শাসনামলে জনগণের মাঝে বিরাজ করেছে নিরানন্দ, স্বজন হারাবার বুক ফাটা আর্তনাদ।

বিজ্ঞাপন

১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর আমি একজন সংবাদকর্মী। সাপ্তাহিক সুগন্ধা পত্রিকা রিপোর্টার হিসাবে কর্মরত। আমার সম্পাদক প্রায়ত খন্দকার মোজাম্মেল হক ( গেদুচাচা) চিফ রিপোর্টার আলম রায়হান। পত্রিকায় তখন প্রখ্যাত সাংবাদিক হাবিবুর রহমান মিলন, কবি শামসুল হক, স্বপন দাশগুপ্ত, শাহজাহান সরদার, নঈম নিজামসহ অনেক খ্যাতিমান সাংবাদিকরা নিয়মিত কলাম লিখতেন। পত্রিকাটি তখন লক্ষাধিক সার্কুলেশন ছিল। খুবই জনপ্রিয় সাপ্তাহিক পত্রিকা।

স্বৈরশাসক সরকার এরশাদের পতনের জন্য পতনের আন্দোলন তখন সারাদেশে স্ফুলিঙ্গ এর মত ছড়িয়ে পড়ে। রাত নেই দিনে রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় বিকট শব্দে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটতো। কখনও পুলিশের ছররা রাইফেলের গুলির শব্দ শোনা যেত। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য স্বৈরশাসক এরশাদ তার নিজস্ব বাহিনী ও পুলিশ, তৎকালীন বিডিআর দিয়ে প্রতিপক্ষের ওপর নির্যাতন। আর সাদা পোশাকের পুলিশ তো ছিলই। ১৯৮৯ সালে মূলত কঠিন আন্দোলনের দানা বাঁধতে শুরু করে। ১৯৯০ সালের শুরু থেকে আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতার হতে থাকে। ওই সময় কর্তব্যরত পুলিশ অফিসাররা আন্দোলন থামাতে হিমশিম খেত। পুলিশের ওয়াকিটকিতে অনেক সময় উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তাদের গালাগাল দেওয়ার কথা শোনা যেত।

একবার প্রেস ক্লাবের সামনে পিকেটারদের হাত থেকে রক্ষার জন্য একজন পুলিশ কর্মকর্তা পুলিশের আইজিকে উদ্দেশ্য করে গালাগাল দিতে দেখেছি। কে গালি দিয়েছে তা তখন চিহ্নিত করার প্রযুক্তি ওয়াকি টকিতে ছিল না। যে কারণে হয়ত কর্তব্যরত পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের গালাগাল দিতে পারত। যাই হোক পহেলা ডিসেম্বর আমরা যারা মাঠে সংবাদ সংগ্রহের জন্য থাকতাম, আমাদের আড্ডা ছিল প্রেস ক্লাবের সামনে। আর সেগুনবাগিচা একটি ছোট হোটেলে। আমরা তখন প্রেস ক্লাবে চত্বরে ঢুকতে পারতাম না। সোজা কথা আমাদের বলা হত রেলিং সাংবাদিক। ওই সময় শুনতে পেলাম সেনাবাহিনীর উচ্চ পর্যায় একটি বৈঠক হয়েছে তারা নাকি এরশাদ সরকারকে আর সহায়তা করবে না। তখন সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল নুরুদ্দিন।

বিজ্ঞাপন

এই খবর ছড়িয়ে পড়ার পর পিকেটারসহ সর্বস্তরের জনগণের মধ্যে সরকার পতনের সময় ঘনিয়ে এসেছে বলে আশার সঞ্চার হয়। তবে এর আগে অর্থাৎ নভেম্বরের শেষের দিকে ইউনিভার্সিটি এলাকায় ডাক্তার শামসুল আলম মিলনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এতে করে আরও আন্দোলন আরো ফুলে ওঠে। এর আগে নিহত হয় জেহাদ।  জেহাদ নিহত হয় দৈনিক বাংলার মোড়ে পুলিশের গুলিতে। সিটি করপোরেশনের কাজের জন্য রাস্তা বন্ধ করে রাখতে সাইনবোর্ড ব্যবহার করত। সাইনবোর্ডে লেখা থাকত সড়ক বন্ধ।

জেহাদ সাইনবোর্ডটি দৈনিক বাংলার মোড় থেকে একটু সামনে এসে সাইনবোর্ডটি পুলিশের দিক রেখে যাচ্ছিল। ওই সময় বেশ কয়েকটি গুলির আওয়াজ আওয়াজ হয়। রাস্তায় ঢলে পড়ে জেহাদ। ওই পুলিশের গুলিতে আহত হয়েছিল ফটোসাংবাদিক সফিউদ্দিন বিটু। বিটু তখন মিয়া মুসা হোসেনের দৈনিক পত্রিকা কর্মরত ছিলেন। খুব সম্ভব ১৯ নভেম্বর স্বৈরাচারের পতন এবং পরবর্তীকালে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য রূপরেখা প্রকাশ করে। এইরূপ লেখা প্রকাশের পর ডাক্তার মিলনকে হত্যা করা হয়। এরশাদ সরকারের পতনের ১০ কিংবা ১২ দিন আগে ঢাকাসহ সারাদেশে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে ওঠে।

২৭ নভেম্বর রাতে সারাদেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে তৎকালীন স্বৈরশাসক হোসাইন মোহাম্মদ এরশাদ। এরশাদ সরকার জারি করেছিল জরুরি অবস্থা। আর রাজনৈতিক দলগুলো ডেকেছিল সারাদেশে অনির্দিষ্টকালের জন্য হরতাল।

বিজ্ঞাপন

নভেম্বরের শেষের দিকে সাংবাদিক সমাজ সংবাদপত্রের প্রকাশনা বন্ধ করা সিদ্ধান্ত নেয়। বাংলাদেশ সংবাদপত্র পরিষদ এই সিদ্ধান্তের প্রতি সমর্থন জানায়। ওই সময় আমিসহ ফটোসাংবাদিক ইত্তেফাকের ফটোসাংবাদিক রশীদ তালুকদার, মোহাম্মদ আলম, লুৎফর রহমান বিনু, বুলবুল আহমেদ, পাভেল আলমাজি আন্দোলনের ছবি এবং রিপোর্ট বিমানবন্দর এগিয়ে কলকাতায় যাত্রীদের কাছে দিতাম যাতে তারা এই ছবি রিপোর্ট কলকাতা সংবাদপত্রে পৌঁছে দেয়। কারণ এছাড়া ছবি এবং রিপোর্ট পাঠানোর কোনো পথ ছিল না। প্রখ্যাত সাংবাদিক আতাউস সামাদ স্যার বিবিসি ঢাকা প্রতিনিধি। তার রিপোর্ট পাঠানো বন্ধ করে দিয়েছিল তৎকালীন স্বৈরশাসক এইচ এম এরশাদ। গিয়াস কামাল চৌধুরী ভয়েজ অব আমেরিকা ঢাকা প্রতিনিধি ছিলেন তিনিও রিপোর্ট পাঠাতে পারতেন না। আত্মগোপনে থেকে তারা রিপোর্ট পাঠাতেন।

যাই হোক জনতার বিক্ষোভের উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ায় হাজার ৯০ সালের ডিসেম্বরের প্রথম দিকে হোসেন মোহাম্মদ এরশাদ জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন। ওই ভাষণে তিনি নির্বাচনের ১৫ দিন আগে ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়ার ঘোষণা দেয়। এরশাদের ওই প্রস্তাব আন্দোলনরত রাজনৈতিক দলগুলো এবং সাধারন জনগণ মেনে না নিয়ে প্রত্যাখ্যান করে আরও কঠিন পদক্ষেপ নেয়। ৪ ডিসেম্বর রাতে স্বৈরাচারী সরকার এরশাদ পদত্যাগ করার সিদ্ধান্ত ঘোষণার পর কারফিউ এবং জরুরি অবস্থা বিধি নিষেধ অমান্য করে রাস্তায় মিছিল উল্লাস নৃত্য শুরু করে। ওইদিন রাতে এই ঘোষণার পর মতিঝিল যাওয়ার পথে আল্লাওয়ালা বিল্ডিং মুহূর্তের মধ্যে জনগণ ভেঙে ফেলে। ওই বিল্ডিংয়ে ছিল জাতীয় পার্টির অফিস এবং প্রধান বিরোধী দল জাসদ রবের অফিস। একদিকে চলছে ওই বিল্ডিং ভাঙার কাজ অন্যদিকে জনতার আনন্দ উল্লাস আর নৃত্য। জনগণ হেলে দুলে নেচে-গয়ে আনন্দ উল্লাস করে।

ওইসময় পল্টন মোড়ে জনতার উদ্দেশ্যে খবর পাঠ করতেন রামেন্দু মজুমদারসহ আরও কয়েকজন গুণীজন ব্যক্তিবর্গ।

বিজ্ঞাপন

সারাবাংলা/একে

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন