বিজ্ঞাপন

হাথুরুসিংহে: কেন ‘টেক ব্যাক’? কেন ‘মুভ ফরোয়ার্ড’ নয়?

February 2, 2023 | 2:06 pm

মাহমুদুল হাসান শামীম

রাসেল ডোমিঙ্গোর বিদায়ের পর জাতীয় ক্রিকেট দলের জন্য নতুন কোচ খুঁজছিল বাংলাদেশ। এই কোচ খঁজতে গিয়ে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড -বিসিবি কেন নেতিবাচক “টেক ব্যাক” সিদ্ধান্ত নিল? কেন সাহসী,পজিটিভ “মুভ ফরোয়ার্ড” সিদ্ধান্ত নিতে পারলো না? কেন বিসিবিকে ফিরে যেতে হলো পুরনো হাথুরু যুগে? যে হাথুরুসিংহে অপেশাদার আচরণে চুক্তি ভঙ্গ করে, বিসিবির অনুরোধকে অসম্মানজনকভাবে অবজ্ঞা করে, ২০১৯ বিশ্বকাপের আগে বাংলাদেশ দলকে অভিভাবকহীন অবস্থায় ছুঁড়ে ফেলে চলেগিয়েছিলেন, তাঁকেই আবার কেন আনতে হলো বিসিবিকে? হাথুরুর সেই অপেশাদার, অসম্মানজনক আচরণের সময় বিসিবির প্রেসিডেন্ট ছিলেন নাজমুল হোসেন পাপান। এখনও তিনিই বিসিবির প্রেসিডেন্ট। কি কারণে তিনি বাংলাদেশের ক্রিকেটে আবার পুনর্বাসিত করলেন হাথুরুকে। বাংলাদেশের তিন ফরম্যাটেই প্রধান কোচ হয়েছেন হাথুরুসিংহে। দুই বছরের জন্য। অসমর্থিত সুত্রে জানা গেছে তাঁর বেতন নাকি দিনে ১ লক্ষ টাকারও বেশি। আগেরবার তাঁর বেতন ছিল মাসে ২৮ হাজার ডলার এবার নাকি ৩৫ হাজার ডলার( প্রায় ৪০ লক্ষ টাকা)।

বিজ্ঞাপন

হাথুরু এবারও টাকা বাড়ানোর ও পদমর্যাদা বাড়ানোর নাটক করেছেন। তিনি বিসিবির সভাপতির সঙ্গে কথা চুড়ান্ত করেও বাংলাদেশের প্রস্তাবের কথা তুলে ধরে দেন দরবার করেছেন অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলস একাডেমির সঙ্গে। যখন তারা জানিয়ে দেয় যে হাথুরুর চাওয়া অনুযায়ী তাঁকে রাজ্য একাডেমির প্রধান করা হবে না তখনই তিনি আবার বিসিবির কর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেন। শ্রীলংকা বোর্ডের বেশি টাকার অফার পেয়ে আগেরবার হাথুরু বাংলাদেশের সঙ্গে যা করেছেন আর এবার বাংলাদেশের অফার পেয়ে নিউসাউথ ওয়েলস একাডেমির সঙ্গে যা করেছেন তা যে আগামীতে বাংলাদেশের সঙ্গে আবার করবেন না তার নিশ্চয়তা কি আছে?

বাংলাদেশ জাতীয় দল থেকে বাদ পড়ারা যেমন আবার দলে ফেরার সুযোগ পান ভালো পারফর্ম করে নয় অন্যরা ভাল করছে না সে কারণে নির্বাচকদের আনুকূল্য পেয়ে। হাথুরুর অবস্থাও ঠিক তাই। বাংলাদেশ ছাড়ার পর ৫ বছর ৪ মাসে তার ভাল কোন পারফর্মেন্স নাই। বরং শ্রীলংকা দলের দায়িত্ব নেয়ার কয়েকমাস পর্ হয়েছেন ওএসডি। আর চুক্তির অর্ধেক সময়ে দেড় বছরের মাথায় তাঁকে বরখাস্ত করেছে লংকান ক্রিকেট বোর্ড। এখন তাকে ফিরে আনা হয়েছে বিসিবি অন্য কাউকে পাচ্ছে না এ কারণে।

কারণ বিসিবি প্রেসিডেন্ট বলেছেন হাই বা মিড লেভেলের কোন কোচ পাওয়া যাচ্ছে না কারণ কেউ সার্বক্ষণিক সময় দিতে রাজী নয়। তারা ১০০ দিন ২০০ দিনের হিসেব করে। এটা অবশ্য ঠিক ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটে একদিকে অনেক টাকা,অন্যদিকে সময় কম দিতে হয়। কিন্তু হাথুরুর মানের তো আরো কোচ পাওয়া যেতো যারা সময় দিতে পারতেন। কোচ না পাওয়ার আরো একটি কারণ আছে। এ পর্যন্ত বাংলাদেশে যে কোচরা এসেছেন তাদের মধ্যে দু একজন ছাড়া বাকী সবাইকেই বিদায় নিতে হয়েছে চুক্তি শেষ হওয়ার আগেই অপ্রীতিকর পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে। বিশ্ব ক্রিকেট সার্কেলে সে খবরটিও তো সবারই জানা। তাই শুধু এবার নয় আগামীতেও বাংলাদেশের জন্য কাংখিত ভাল কোচ পাওয়া কঠিনই হবে।

বিজ্ঞাপন

বিসিবির সভাপতি বলেছেন হাথুরুকে আনার আরেক কারণ তার অতীত পারফরমেন্স। হ্যাঁ প্রথম দফায় হাথুরুসিংহের সময় (২০১৪-২০১৭) বাংলাদেশ দলের স্মরণীয় কিছু পারফর্মেন্স ছিল। ২০১৫ ওডিআই বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনাল, ২০১৭ সালে আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে সেমিফাইনাল খেলেছে বাংলাদেশ। দেশের মাটিতে পাকিস্তান, ভারত এবং দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে টানা তিনটি ওডিআই সিরিজ জিতেছে। দেশের মাটিতে ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া এবং শ্রীলংকায় নিজেদের শততম টেস্ট জয়ের কৃতিত্বও আছে। কিন্ত এর প্রেক্ষাপটটি কি ছিল। বাংলাদেশের ইতিহাসের সেরা দলটি পেয়েছিলেন তখন হাথুরুসিংহে। পঞ্চপান্ডব তখন অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ। ফর্মের তুঙ্গে। দলের কার্যকরি নিউক্লিয়াস। তার প্রতিফলন ছিল মাঠের পারফরমেন্সে।

হ্যা হাথুরুসিংহে প্রতিপক্ষের দূর্বলতা বুঝে মিরপুরে ভয়ানক টার্নিং উইকেট বানিয়ে ইংলিশ ও অজি এবং সফরকারি দলগুলোকে কুপোকাৎ করেছেন। হোম টিমের এডভান্টেজকে কাজে লাগিয়েছেন। তবে নেতিবাচক এই স্ট্র্যাটেজি বাংলাদেশের ক্রিকেটের দীর্ঘ মেয়াদী কি ক্ষতি করেছে তা পরবর্তীতে এ্যাওয়ে ম্যাচ-সিরিজগুলোতে দেখা গেছে।

তবে তিনি সার্বিকভাবে ক্ষতি করেছেন বাংলাদেশের ক্রিকেট রীতিনীতির। তাঁর বিতর্কিত কর্মকান্ডের কারণে পদত্যাগ করেছিলেন ক্রিকেট অপারেসন্সের প্রধান নাঈমুর রহমান দূর্জয়, নির্বাচক প্যানেলের প্রধান ফারুক আহমেদ, সমস্যা ছিল টিম ডিরেক্টর খালেদ মাহমুদ সুজনের সঙ্গে। খেলোয়াড়দের সঙ্গেও তাঁর বনিবনা ছিল না। মাশরাফিকে ওয়ানডে দল থেকে সরিয়ে দলটির ক্ষতি করেছেন। মুমিনুলকে প্রথমে ওয়ানডে পরে টেস্ট দল থেকেই বাদ দিয়েছিলেন। অধিনায়কের ইচ্ছাকে উপেক্ষা করে মাহমুদুল্লাহকে শততম ম্যাচ থেকে বাদ দিয়েছিলেন। মাশরাফির অনড় সমর্থনের কারণে ওয়ানডে দল থেকে যান মাহমুদুল্লাহ। তামিম ইকবালকে খেলাতে চেয়েছিলেন তিন নম্বরে। তামিম তাতে রাজী হন নি। ওপেনিংয়েই অনড় থাকেন। আর সাকিবের সঙ্গে টানাপোড়ানের খবর তো প্রায়ই এসেছে মিডিয়ায়।

বিজ্ঞাপন

এ ধরণের কাজ তিনি করেছেন শ্রীলংকা দলে গিয়েও। তাদের প্রধান নির্বাচক বিদায় নিয়েছেন। অধিনায়ককে সরে দাড়াতে হয়েছে। ২০১৯ বিশ্বকাপের পর হাথুরুর ব্যাপারে লংকান দলের অধিনায়ক লিখিত অভিযোগ জানিয়েছিলেন বোর্ডকে। বোর্ড হাথুরুকে প্রথমে ওএসডি করে রাখে কিছুদিন। লংকান বোর্ড প্রেসিডেন্ট তখন প্রায়ই বলেছেন যে অপাত্রে প্রতিমাসে ৪০ হাজার ডলার ঢালা হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত চুক্তির মাঝামাঝি সময়ে দেড় বছরের মাথায় তাঁকে বিদায় করে দেয় লংকান বোর্ড।

বাংলাদেশ দলের সাফল্য দেখে লংকান বোর্ড তাঁকে বেশি ডলারের অফার দেয়ায় হাথুরু ২০১৭ সালে বাংলাদেশ দলের দক্ষিণ আফ্রিকা সফর শেষে ঢাকায় না ফিরে সম্পূর্ন অপেশাদার আচরণে ই-মেইল পাঠিয়ে পদত্যাগ করে কলম্বো চলে যান। পরে বিসিবি তাঁকে ঢাকায় এনে ২০১৯ বিশ্বকাপ পর্যন্ত থাকার জন্য অনুরোধ করে। তিনি তখন বিসিবি কর্তাদেরকে অসম্মানজকভাবে উপেক্ষা করে হোটেল ছেড়ে যান। সে খবরও মিডিয়ায় এসেছিল। বিসিবি কর্তারা তা ভুলে সেই স্বেচ্ছাচারি হাথুরুকে আবার বাংলাদেশের ক্রিকেটে পুনর্বাসিত করছেন।

কিন্তু তাঁকে কি ওয়ার্ম ওয়েলকাম জানানো হবে বাংলাদেশ দলের ড্রেসিং রুমে? সিলেটে বিপিএলয়ের ম্যাচ শেষে হাথুরু সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে সাকিবের উত্তর ছিল-নো কমেন্ট। এই উত্তর থেকেই বুঝা যাচ্ছে খেলোয়াড়রা কেমনভাবে নিচ্ছেন হাথুরুর ফেরাকে। বোর্ড কর্তাদের একাংশ ( সম্ভবত বোর্ড প্রেসিডেন্টও এই দলেই ) হাথুরুকে চেয়েছেন সাকিবদের লাইনে রাখার জন্য। বন্ধুসুলভ, নরম-সরম কোচ তাদের পছন্দ নয়। তারা চান হেডমাস্টারসুলভ কড়া কোচ। হেডমাস্টারি করে হাথুরু কিন্তু লংকান দলটিকে ডুবিয়েছেন ২০১৯ বিশ্বকাপে। তারই খেসারতে তাকে বরখাস্ত হতে হয়েছে চুক্তিসীমার মাঝ পথেই। অথচ দেখুন বন্ধুসুলভ কোচ লিওনেল স্কালোনি দলের খেলোযাড়দের কাছ থেকে কেমন পারফরমেন্স বের করে দলকে বিশ্বকাপ জিতিয়েছেন। হেডমাস্টারসুলভ আচরণে নয় পারস্পরিক শ্রদ্ধা, সম্মান, ভালবাসা, আস্থা, ভরসার মাধ্যমে আনুগত্য অর্জন করে দলের খেলোয়াড়দের কাছ থেকে সেরাটা বের করে আনতে হয়।

কেউ কেউ বলেন হাথুরুর নাকি প্রতিপক্ষের দূর্বলতা ধরে তা কাজে লাগানোর ম্যাজিক জানেন। কিন্তু যে বাংলাদেশ দলকে নিয়ে তিন বছর কাজ করেছেন সেই দলের কাছেই তার লংকান দল হেরেছে। হেরেছে আফগানিস্তানের কাছেও। আসলে দাঁড়িয়ে যাওয়া পঞ্চপান্ডবের বাংলাদেশ দল নিয়ে হাথুরু কয়েকটি সাফল্য পেয়েছেন কিন্তু তৈরি হচ্ছে এমন লংকান দল নিয়ে তিনি ব্যর্থতায় ডুবেছেন। বাংলাদেশের ক্রিকেটেও এখন পালাবদল চলছে। মাশরাফি নেই। বিদায় নেয়ার পথে পঞ্চপান্ডবের অন্যরাও। তৈরি হওয়ার সময় নতুন দলের। এমন পরিস্থিতিতে তিনি কি করবেন লংকান অভিজ্ঞতা থেকে তা নিয়ে সংশয় অনেক। শ্রীলংকার মতো তিনি বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্যও বুমেরাং হন কিনা তা নিয়ে আশংকা থাকছেই।

বিজ্ঞাপন

আরেকটি ব্যাপারেও আশংকা প্রবল। সামনেই বিশ্বকাপ। বাংলাদেশের ওয়ানডে দলটি এখন ভাল অবস্থায় আছে। এই বিশ্বকাপে বাংলাদেশ ভাল করবে এমন ধারণা দেশে বিদেশে সবারই। কিন্তু হাথুরুসিংহের যে চরিত্র,তিনি যদি এসেই এই দলে ভাঙচুর শুরু করেন তাহলে এই বিশ্বকাপে লংকান দলের মতোই অবস্থা হতে পারে তামিমদের।

আগেরবার হাথুরু ক্রিকেট অপারেসন্স, নির্বাচক প্যানেল, অধিনায়ক সবাইকে উপেক্ষা করে সরাসরি যোগাযোগ করে প্রভাবিত করতেন বিসিবি প্রেসিডেন্ট নাজমুল হাসান পাপনকে। বিসিবি প্রধানও বোধহয় তা বেশ পছন্দ করতেন। এবার অনেকেই বলছেন হাথুরুর এমন অতীত সত্বেও তিনি যে আবার আসছেন তা মূলত বিসিবি প্রধানের পছন্দের কারণেই। আগেরবারেই মনে হতো বিসিবি প্রধানের পরেই ক্ষমতাশালী ব্যক্তি হাথুরুসিংহে। মিডিয়ায় আসা খবর অনুযায়ী এবার নাকি তিনি আসছেন নানান শর্তদিয়ে আরো ক্ষমতাবান হয়ে। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড কর্তারা এই হাথুরুকে সামলাতে পারবেন তো? নাকি সময় হারিয়ে বাংলাদেশ দলের বারোটা বাজার পর শেষ পর্যন্ত লংকান বোর্ডের মতোই সিদ্ধান্ত নিতে হয় বিসিবিকেও!

পুনশ্চ: বাংলাদেশ ক্রিকেটের একনিষ্ঠ শুভাকাংখীদের একজন হয়ে মনেপ্রাণে চাই এসব আশংকা ভুল প্রমাণিত হোক। আগের সেই হাথুরুকে নয় নতুন হাথুরুসিংহেকে যেন পায় বাংলাদেশ। এগিয়ে যেন যায় বাংলাদেশের ক্রিকেট।“ টেক ব্যাক” নয় “মুভ ফরোয়ার্ড” এর নতুন পথেই যেন ছুটতে পারেন তামিম-সাকিবরা।

লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক, ক্রীড়া বিশ্লেষক

সারাবাংলা/এসবিডিই

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন