বিজ্ঞাপন

ভারতের হঠাৎ শুল্কে অস্থির পেঁয়াজ বাজার

August 20, 2023 | 10:14 pm

রমেন দাশগুপ্ত, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

চট্টগ্রাম ব্যুরো: রফতানিতে ভারতের হঠাৎ ৪০ শতাংশ শুল্ক ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই দেশে পেঁয়াজের দাম কেজিপ্রতি অন্তত ১৫ টাকা বেড়ে গেছে। ফলে আড়াই মাসের ব্যবধানে দেশে পেঁয়াজের বাজার ফের অস্থির হয়ে উঠল। বাজারে শুধু ভারতের পেঁয়াজের দাম বেড়েছে এমন নয়, দেশি পেঁয়াজের দামও অন্তত ১৫ টাকা বাড়িয়ে দিয়েছে ব্যবসায়ীরা।

বিজ্ঞাপন

আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, ভারত রফতানি শুল্ক প্রত্যাহার না করলে এবং বিকল্প দেশ থেকে আমদানির উদ্যোগ নেওয়া না হলে সরবরাহ ব্যবস্থায় বড় ধরনের ঘাটতি দেখা দেবে এবং এতে পেঁয়াজের দাম আরও বাড়বে।

দেশের প্রান্তিক কৃষকদের সুবিধা দিতে চলতি বছরের মার্চ থেকে দেশে পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি বন্ধ করে দিয়েছিল সরকার। আমদানি বন্ধের কারণে সে সময় পেঁয়াজের দাম বাড়তে বাড়তে কেজিপ্রতি ১০০ টাকা ছাড়িয়ে যায়। এরপর ৫ জুন থেকে পেঁয়াজ আমদানির সুযোগ দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। আমদানির অনুমতি আসার পর এক রাতেই বাজারে কেজিপ্রতি পেঁয়াজের দাম কমে অন্তত ৩০ টাকা।

এরপর শনিবার (১৯ আগস্ট) ভারতের অর্থ মন্ত্রণালয় এক বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, আগামী ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত পেঁয়াজ রফতানির ওপর ৪০ শতাংশ শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হয়েছে। এর আগ পর্যন্ত পেঁয়াজ শুল্কমুক্ত পণ্য হিসেবেই রফতানি হতো।

বিজ্ঞাপন

ভারতের ঘোষণা আসার অপেক্ষা মাত্র, রোববার সকাল থেকেই চট্টগ্রামে ভোগ্যপণ্যের বৃহত্তম পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে আড়তদার ও পাইকারি বিক্রেতারা পেঁয়াজ বিক্রি প্রায় বন্ধ করে দেন। কেজিপ্রতি পেঁয়াজের দাম অন্তত ১৫ টাকা বেশি দাবি করলে বিক্রি এমনিতেই কমে আসে। একইভাবে খুচরা বাজারেও কেজিপ্রতি দাম অন্তত ১৫ টাকা বেড়েছে।

ফাইল ছবি

বাজার ঘুরে জানা গেছে, খাতুনগঞ্জের আড়ৎ ও পাইকারি দোকানে বর্তমানে দেশে উদৎপাদিত ও ভারতের নাসিক অঞ্চলের পেঁয়াজ আছে। ভারতের মধ্যম মানের পেঁয়াজ শনিবার বিক্রি হয়েছে কেজিপ্রতি ৪০ থেকে ৪২ টাকা এবং ভালো মানের প্রতিকেজি ৪৮ টাকা। একইদিন দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে প্রতিকেজি ৬০ থেকে ৬৫ টাকায়।

রোববার (২০ আগস্ট) ভারতের মধ্যম ও ভালো পেঁয়াজ খাতুনগঞ্জের আড়তদার ও পাইকারি বিক্রেতারা বিক্রি করেছেন ৬০ থেকে ৬২ টাকায়। আর দেশি পেঁয়াজ বিক্রি করেছেন ৭৫ থেকে ৮০ টাকায়।

বিজ্ঞাপন

খাতুনগঞ্জের হামিদউল্লাহ মার্কেটের পেঁয়াজের আড়তদার মো. ইদ্রিস সারাবাংলাকে বলেন, ‘স্থলবন্দর দিয়ে ভারত থেকে আসা নাসিক ও ইন্দোর জাতের পেঁয়াজ এখন আমাদের কাছে আছে। নাসিকের পেঁয়াজ ৬০-৬২ টাকা এবং ইন্দোর পেঁয়াজ ৫০ থেকে ৫২ টাকায় বিক্রি করেছি। তবে নাসিকের পেঁয়াজের চাহিদা দেশে বেশি। ইন্ডিয়া হঠাৎ করে শুল্ক আরোপের কারণে কেজিপ্রতি প্রায় ১৫ টাকা বেড়েছে।’

ভারতের শুল্ক আরোপের কারণে দাম বাড়ার বিষয়টি সারাবাংলার কাছে ব্যাখা করেছেন খাতুনগঞ্জের মেসার্স ইরা ট্রেডার্সের স্বত্ত্বাধিকারী মো. ওমর ফারুক। তার দেয়া তথ্যানুযায়ী, ভারতের নাসিক অঞ্চল থেকে আমদানিকারকদের পেঁয়াজ কিনতে হচ্ছে প্রতিকেজি ২৭ থেকে ২৮ ভারতীয় রুপি দিয়ে। এর সঙ্গে যোগ হচ্ছে ৪০ শতাংশ শুল্ক, যা অন্তত ১২ রুপির সমান। এর সঙ্গে ৬ রুপি গাড়ি ভাড়া, ৪ রুপি বর্ডার ট্যাক্স মিলিয়ে প্রতিকেজি পেঁয়াজের কেনাদাম পড়ছে অন্তত ৫২ রুপি। প্রতি রুপির বিপরীতে ১ টাকা ৩১ পয়সা হিসেবে স্থলবন্দরেই পেঁয়াজের দাম পড়ছে কেজিপ্রতি ৬৮ টাকা ১২ পয়সা।

ফারুক বলেন, ‘হিলি, সোনামসজিদ, ভোমড়া বর্ডারে যে পেঁয়াজ ৬৮ টাকায় আসছে, সেটা তো আমরা খাতুনগঞ্জে বসে সেই দামে পাব না। এর সঙ্গে তিন টাকা গাড়িভাড়া, এক টাকা খালাস খরচ, এক টাকা লেবার চার্জ এবং পচে নষ্ট হওয়া বাবদ এক টাকা যোগ করতে হবে। তাহলে আমাদের ভারত থেকে আমদানি করা পেঁয়াজ বিক্রি করতে হবে ৭০ টাকার বেশি।’

ভোমরা স্থলবন্দর দিয়ে পেঁয়াজ আমদানি করেন পাবনার ব্যবসায়ী মো. ওমর আলী ফকির। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘বর্ডারে গতকাল আমরা ৫০-৫২ টাকা কেজিতে ভারতের পেঁয়াজ বিক্রি করেছি। ডিউটি বাড়ার পর আজ ৬৭-৬৮ টাকায় বিক্রি হয়েছে। ভারতের পেঁয়াজে আমাদের লস হচ্ছে। পেঁয়াজ পচা পড়ছে, নষ্ট হচ্ছে, এরপর আবার ডিউটি বাড়িয়ে দিল। ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ করে দেওয়া ছাড়া উপায় নেই।’

বিজ্ঞাপন

আড়তদার মো. ইদ্রিস সারাবাংলাকে বলেন, ‘বর্ডার থেকে আজ (রোববার) যেসব পেঁয়াজ এসেছে, সেগুলো কাল বাজারে আসবে। স্বাভাবিকভাবেই সেগুলো যেহেতু বাড়তি দামে কিনতে হয়েছে, আমাদের বাড়তি দামে বিক্রি করতে হবে।’

নতুন আমদানির বাইরে যেসব পেঁয়াজ আড়তে আছে, সেগুলোর দাম বাড়িয়ে দেয়ার বিষয়টি স্বীকার করে নিয়েছেন খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীরা।

ফাইল ছবি

ওমর ফারুক সারাবাংলাকে বলেন, ‘যার কাছে আগের দামে কেনা এক গাড়ি অর্থাৎ ১৪ টন পেঁয়াজ আছে, ধরে নিলাম সেখান থেকে তিনি ১০ টন আগের দামেই বিক্রি করে দিয়েছেন, বাকি রয়ে গেল আরও চার টন। রানিংয়ের মধ্যে সেটা বিক্রি করে যদি তিনি দুই-চার টাকা বেশি পান, সেই সুযোগ তিনি কেন নেবেন না? আসলে পেঁয়াজ গুদামে মজুত করে দাম বাড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। রানিংয়ের মধ্যেই আমরা যা বেশি পাচ্ছি, সেটা নিচ্ছি।’

মো. ইদ্রিস সারাবাংলাকে বলেন, ‘ব্যবসায়ীদের তো ৭০ টাকায় পেঁয়াজ কিনে ৪০ টাকায় বিক্রি করতে হয়েছে, এমন ঘটনা আছে। এখন হঠাৎ করে ডিউটি বেড়ে যাওয়ার কারণে দুই/চার টাকা বাড়তি পাচ্ছে আর কী! তার মানে এই নয় যে, মার্কেটে শত, শত টন পেঁয়াজ আছে। বাজারে এমনিতেই পেঁয়াজের সরবরাহে ঘাটতি আছে।’

শুধু পাইকারি বাজার নয়, চট্টগ্রামের খুচরা বাজারেও পেঁয়াজের দাম একদিনের ব্যবধানে ১০ থেকে ১৫ টাকা বেড়ে প্রতিকেজি ৭০ টাকায় পৌঁছেছে। রোববার বিকেলে নগরীর কাজীর দেউড়ি কাঁচাবাজারে ও দুই নম্বর গলিতে আনোয়ার স্টোর, ভাই ভাই ডিপার্টমেন্ট স্টোর ও চেমন গ্রোসারিতে ৭০ টাকায় ভারতের পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে। ফয়েজ স্টোর ও হক ভাণ্ডারি স্টোরে ৬৫ টাকায় পেঁয়াজ বিক্রি করতে দেখা গেছে।

আনোয়ার স্টোরের স্বত্ত্বাধিকারী আনোয়ার হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘গতকাল (শনিবার) আমরা ৫৫-৬০ টাকা কেজি বিক্রি করেছি। আজ ৭০ টাকায় বিক্রি করছি। খাতুনগঞ্জে সারাদিন ঘুরে এক বস্তা পেঁয়াজ কিনতে অনেক কষ্ট হয়েছে। কেজিতে পাইকারিতে ১৫-২০ টাকা বেড়ে গেছে। বাড়তি দামেও অনেকে পেঁয়াজ বিক্রি করতে রাজি হচ্ছে না।’

পেঁয়াজের বাজারে অস্থিরতা কাটবে কীভাবে? এ প্রসঙ্গে ব্যবসায়ীদের মত হচ্ছে, ভারতের রফতানি শুল্ক দ্রুত প্রত্যাহারের বিষয়ে সরকারি উদ্যোগ নিতে হবে। না হলে বিকল্প দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি দ্রুত দিতে হবে।

খাতুনগঞ্জের মেসার্স ইরা ট্রেডার্সের স্বত্ত্বাধিকারী মো. ওমর ফারুক সারাবাংলাকে বলেন, ‘ভারতের বিকল্প হচ্ছে বাংলাদেশ এবং মিয়ানমার। কিন্তু দেশে উৎপাদিত নতুন ফসল উঠবে জানুয়ারিতে। সুতরাং সেটা পাওয়ার সম্ভাবনা এখন নেই। এরপর মিয়ানমার। এই মুহূর্তে মিয়ানমার থেকে পেঁয়াজ কিনে টেকনাফ বন্দর পর্যন্ত আনতে খরচ হচ্ছে প্রতি কেজিতে অন্তত ৭৫ থেকে ৮০ টাকা। সেটা আমাদের বিক্রি করতে হলে ৮৫-৯০ টাকায় বিক্রি করতে হবে। তাহলে সেই আশাও শেষ।’

তিনি আরও বলেন, ‘এখন বিকল্প সন্ধান করতে হবে। মিশর, তুরস্ক, চীন, পাকিস্তান, থাইল্যান্ডের বাজারের দিতে নজর দিতে হবে। সরকার যত দ্রুত সম্ভব আমদানির অনুমতি দিয়ে প্রক্রিয়া শুরু করবে তত দ্রুত দেশের বাজার স্থিতিশীল হয়ে আসবে। এছাড়া বাংলাদেশের জন্য পেঁয়াজের রফতানি শুল্ক প্রত্যাহারের বিষয়ে সরকারি পর্যায় থেকে আলাপ-আলোচনা শুরুর মাধ্যমে উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।’

দেশে বছরে পেঁয়াজের চাহিদা আছে প্রায় ২৮ থেকে ৩০ লাখ মেট্রিক টন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের হিসেবে, প্রতিবছর দেশে পেঁয়াজের উৎপাদন বাড়ছে। গেল মৌসুমে দেশে পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছে ৩৪ লাখ টনের বেশি। কিন্তু উপযুক্ত সংরক্ষণের অভাবে বা প্রতিকূল পরিবেশের কারণে ৩০–৩৫ শতাংশ পেঁয়াজ নষ্ট হয়ে গেলে আমদানির মাধ্যমে ঘাটতি পূরণ করতে হয়।

বাংলাদেশে আমদানি করা পেঁয়াজের সিংহভাগই আসে ভারত থেকে বিভিন্ন স্থলসীমান্ত দিয়ে। টেকনাফ স্থলবন্দর দিয়ে আসে মিয়ানমারের পেঁয়াজ, তবে পরিমাণে খুবই কম। এর বাইরে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে বিভিন্ন দেশ থেকে জাহাজের মাধ্যমে আসে পেঁয়াজ, যা খুবই নগণ্য পরিমাণে বলে জানিয়েছেন আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীরা।

২০২১-২২ অর্থবছরে আমদানি উন্মুক্ত থাকায় পেঁয়াজ আমদানি বেশি হয়েছিল। তখন দেশি পেঁয়াজের বাজার দর ছিল প্রতিকেজি ৩০ থেকে ৩৫ টাকা। চাষে কৃষকের আগ্রহ ধরে রাখতে কৃষি মন্ত্রণালয় পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ রেখেছিল। এ কারণে দাম বেড়ে গেলে ৫ জুন থেকে ফের আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়। ৫ জুন থেকে ১৬ আগস্ট পর্যন্ত সর্বমোট ১২ লাখ ৯৩ হাজার ৬৮৪ টন পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি (আইপি) দেওয়া হয়েছিল। যদিও নির্ধারিত আইপি’র এক চতুর্থাংশ পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।

সারাবাংলা/আরডি/পিটিএম

Tags: , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন