বিজ্ঞাপন

এক নির্বাচনে টালমাটাল চট্টগ্রাম মহানগর আ.লীগ

January 3, 2024 | 10:50 pm

রমেন দাশ গুপ্ত, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

চট্টগ্রাম ব্যুরো: বন্দর-পতেঙ্গা আসনে চতুর্থ দফায় এম এ লতিফকে নৌকার প্রার্থী করেছে আওয়ামী লীগ। কিন্তু চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগ সেই মনোনয়ন মেনে নিতে পারেনি। লতিফের বদলে অন্য কাউকে মনোনয়নের দাবি ওঠে নগর আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সভায়। সর্বসম্মত সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে লতিফকে পরিবর্তনের দাবি জানিয়ে দলের সংসদীয় মনোনয়ন বোর্ডের কাছে চিঠি পাঠানো হয়।

বিজ্ঞাপন

কিন্তু নির্বাচন ঘনিয়ে আসতেই নগর আওয়ামী লীগের সেই অবস্থানের ব্যত্যয় ঘটিয়ে একদল নেতা দাঁড়িয়েছেন লতিফের পাশে, যার নেতৃত্বে আছে নগর কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী। অন্যদিকে নগর কমিটির সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির ‍উদ্দীন ও সহসভাপতি খোরশেদ আলম সুজনসহ আরেক গ্রুপ এখনো রয়ে গেছে লতিফের বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থী জিয়াউল হক সুমনের সঙ্গে।

বোয়ালখালী-চান্দগাঁও আসনে শুরু থেকেই আ জ ম নাছির উদ্দীন ও তার অনুসারীরা মিলে আছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী নগর আওয়ামী লীগের সদস্য বিজয় কুমার চৌধুরীর সঙ্গে। কিন্তু বন্দর-পতেঙ্গায় নাছিরের সঙ্গী খোরশেদ আলম সুজনসহ আরেক গ্রুপ দাঁড়িয়েছেন আরেক স্বতন্ত্র প্রার্থী নগর কমিটির কোষাধ্যক্ষ ও সিডিএর সাবেক চেয়ারম্যান আবদুচ ছালামের সঙ্গে।

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এমন টালামাটাল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগে। দৃশ্যত সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে। বড়, ছোট, মাঝারি সব নেতাই নিজের সিদ্ধান্তে অনুসারীদের নিয়ে বিভিন্ন পক্ষভুক্ত হচ্ছেন। আলোচনা আছে, আপাতত দলকে একপাশে রেখে ‘নির্বাচনি সুযোগ-সুবিধা’ আদায় করে নিচ্ছেন নেতাকর্মীরা।

বিজ্ঞাপন

এ পরিস্থিতিকে অবশ্য সাংগঠনিক শৃঙ্খলার অভাব বলে মনে করছেন না নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীন। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘দল এবার স্বতন্ত্র প্রার্থিতার সুযোগ দিয়েছে, নেতাকর্মীরাও যার যার পছন্দ অনুযায়ী প্রার্থীর পক্ষে কাজ করার সুযোগ পেয়েছেন। এ জন্য অনেকে ভিন্ন ভিন্ন প্রার্থীর পক্ষে কাজ করছেন বা অনেকে নির্বাচনে একজন আরেকজনের বিরুদ্ধে প্রার্থী হয়েছেন।’

চট্টগ্রাম-৮ আসনে নৌকার প্রার্থীর পক্ষে সহসভাপতি খোরশেদ আলম সুজনসহ মহানগর আওয়ামী লীগের একাংশের সমর্থন রয়েছে। ছবি: সারাবাংলা

‘কিন্তু আমরা মনে করি, এটা শুধুমাত্র ৭ জানুয়ারি ভোটের ফলাফল ঘোষণা পর্যন্ত। জনগণ যাকে ভোট দেবেন, প্রার্থী ও তাদের সমর্থকরা সবাই ফলাফল মেনে নেবেন। পরদিন থেকেই তারা সবাই আবার আগের মতো সাংগঠনিক দায়িত্বে ফিরে আসবেন। আগের মতোই নেতাকর্মীরা সাংগঠনিক শৃঙ্খলা মেনে রাজনৈতিক কার্যক্রমে যুক্ত হবেন। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনেও এমন আশঙ্কা করা হয়েছিল। কিন্তু সেটা মিথ্যা প্রমাণ করে নির্বাচন শেষে সবাই সুশৃঙ্খলভাবে কাজ করছেন,’— বলেন আ জ ম নাছির।

চট্টগ্রাম মহানগরীর চারটি সংসদীয় আসনের মধ্যে নৌকার প্রার্থী আছে তিনটিতে। এর মধ্যে দৃশ্যত নৌকা সবচেয়ে বেশি ‘চাপে’ আছে চট্টগ্রাম-১১ (বন্দর-পতেঙ্গা) আসনে। আওয়ামী লীগের প্রার্থী এম এ লতিফকে মানছেন না এ আসনে দলটির অধিকাংশ নেতাকর্মী। তিনবার নৌকা প্রতীকে নির্বাচিত হওয়া লতিফ দলটির নেতাকর্মীদের কাছে ‘উড়ে এসে জুড়ে বসা’ সংসদ সদস্য হিসেবে পরিচিত।

বিজ্ঞাপন

এবার লতিফের বিরুদ্ধে এ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন জিয়াউল হক সুমন। প্রতীক পেয়েছেন কেটলি। সুমন ৩৯ নম্বর দক্ষিণ হালিশহর ওয়ার্ডের দুবারের কাউন্সিলর। তিনি ওই ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক।

গত ২৮ নভেম্বর নগর আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সভায় সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে পরদিন দলের সংসদীয় মনোনয়ন বোর্ডের কাছে এম এ লতিফকে পরিবর্তনের অনুরোধ করে চিঠি পাঠানো হয়। এরপর স্বতন্ত্র প্রার্থী জিয়াউল হক সুমনের এক কর্মী সমাবেশে যোগ দেন আ জ ম নাছির উদ্দীন। ওই আসনে মনোনয়নের জোর দাবিদার নগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি খোরশেদ আলম সুজন ও আলতাফ হোসেন চৌধুরীও সুমনের পাশে দাঁড়ান। দাবার ছক উল্টে যায়। থানা-ওয়ার্ড-ইউনিটে কমবেশি সবাই প্রকাশ্যে সমর্থন দেন সুমনকে। লতিফ কোণঠাসা হয়ে পড়েন।

কিন্তু নির্বাচনের চার দিন আগে মঙ্গলবার (২ জানুয়ারি) বিকেলে নগরীর ২৭ নম্বর উত্তর আগ্রাবাদ ওয়ার্ডে এম এ লতিফকে সঙ্গে নিয়ে প্রচারে নামেন মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী, সাংগঠনিক সম্পাদক শফিক আদনান, আইন সম্পাদক ইফতেখার সাইমুল চৌধুরী, সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য মাহবুবুল হক মিয়া, জালাল উদ্দীন ইকবাল, দিদারুল আলম চৌধুরী, চন্দন ধর, মশিউর রহমান চৌধুরী, বখতিয়ার উদ্দিন খান এবং কাউন্সিলর জহরলাল হাজারী, শহীদুল আলম, গোলাম মোহাম্মদ চৌধুরী ও আবদুল বারেক।

চট্টগ্রাম-৮ আসনেই আবার স্বতন্ত্র প্রার্থী বিজয়ের পক্ষে রয়েছেন সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছিরসহ মহানগর আওয়ামী লীগের আরেক অংশ। ছবি: সারাবাংলা

এ বিষয়ে জানতে চাইলে আ জ ম নাছির উদ্দীন সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রার্থী পরিবর্তনের অনুরোধ করে নগর আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় যে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, সেখানে উনারাও ছিলেন। তারপরও দল যেহেতু কে কার পক্ষে যাবেন সেটা ওপেন করে দিয়েছে, আমি উনাদের অবস্থানকে বাঁকা চোখে দেখছি না। উনারা হয়তো উনাদের অবস্থান সঠিক মনে করছেন। এটা উনাদের ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গীর বিষয়।’

বিজ্ঞাপন

চট্টগ্রাম-১০ (ডবলমুরিং, হালিশহর, পাহাড়তলী, খুলশী ও পাঁচলাইশ আংশিক) আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মো. মহিউদ্দিন বাচ্চু। তিনি নগর যুবলীগের সাবেক আহ্বায়ক। ওই কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক ফরিদ মাহমুদ কেটলি প্রতীক নিয়ে ওই আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। এর ফলে আওয়ামী লীগ ও বিভিন্ন সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা দুভাগে ভাগ হয়ে পড়েছেন।

আ জ ম নাছির উদ্দীন ও তার অনুসারী নেতাকর্মীরা মহিউদ্দিন বাচ্চুর পক্ষে একাট্টা। নগর আওয়ামী লীগের মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল বলয়ের শক্তিশালী গ্রুপটির অধিকাংশ নেতাকর্মীকেই অবশ্য তার পাশে সক্রিয়ভাবে দেখা যাচ্ছে না। তবে শেষ মুহূর্তে বুধবার (৩ জানুয়ারি) সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী তার পক্ষে গণসংযোগে নেমেছেন। সঙ্গে ছিলেন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বদিউল আলম, আইন বিষয়ক সম্পাদক শেখ ইফতেখার সাইমুল চৌধুরী, ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক মোহাম্মদ হোসেন, যুবলীগের সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য সৈয়দ মাহমুদুল হক, সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক দেলোয়ার হোসেন খোকা, নগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক কে বি এম শাহজাহান ও বর্তমান সাধারণ সম্পাদক আজিজুর রহমান আজিজ এবং কাউন্সিলর নুরুল আমিন।

স্থানীয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের একাংশ আছে ফরিদ মাহমুদের সঙ্গে। একই আসনের আরেক স্বতন্ত্র প্রার্থী সাবেক সিটি মেয়র এম মনজুর আলমের পক্ষেও থানা-ওয়ার্ড-ইউনিট আওয়ামী লীগের অনেকে আছেন।

একমাত্র চট্টগ্রাম-৯ (কোতোয়ালি-বাকলিয়া-চকবাজার) আসনে নির্বাচন ঘিরে আওয়ামী লীগে কোনো বিভক্তি তৈরি হয়নি। এ আসনে দলটির প্রার্থী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলকে ঘিরে সবাই একাট্টা। নিজের অনুসারীদের পাশাপাশি তিনি পাশে পেয়েছেন আ জ ম নাছির উদ্দীন এবং তার অনুসারীদেরও।

চট্টগ্রাম-৮ (বোয়ালখালী, চান্দগাঁও, পাঁচলাইশ ও বায়েজিদ বোস্তামির একাংশ) আসন আওয়ামী লীগ জাতীয় পার্টিকে ছেড়ে দিয়েছে। এ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নবঞ্চিত হয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে আছেন দুজন— নগর আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ ও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) সাবেক চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম এবং নগর কমিটির সদস্য ও চসিকের জামালখান ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর বিজয় কুমার চৌধুরী। এ আসনে দৃশ্যত আওয়ামী লীগ তিনভাবে বিভক্ত হয়ে পড়েছে।

বিজয় কুমার চৌধুরী চট্টগ্রামের রাজনীতিতে আ জ ম নাছির উদ্দীনের অনুসারী হিসেবে পরিচিত। স্বাভাবিকভাবেই নাছির ও তার অনুসারীরা শুরু থেকেই বিজয়ের পাশে আছেন। ওই আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য নগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নোমান আল মাহমুদ। তিনিও নাছিরের অনুসারী। নোমানও বিজয়ের পাশে দাঁড়িয়েছেন।

নাছির যখন সিটি মেয়র ছিলেন, তখন ছালাম সিডিএর চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছিলেন। দুই সংস্থার প্রধানের মধ্যে সে সময় স্নায়ুযুদ্ধ ছিল। সার্বিকভাবে ছালামের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে প্রচার চালাচ্ছেন নাছির। বুধবার (৩ জানুয়ারি) বিজয়ের পক্ষে গণসংযোগে গিয়ে ছালামের নাম উল্লেখ না করে নাছির কারও মুখরোচক কথায় ভুলে ভোট না দিতে ভোটারদের প্রতি আহ্বান জানান।

অন্যদিকে নগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ইব্রাহিম হোসেন চৌধুরী বাবুল, খোরশেদ আলম সুজন ও আলতাফ হোসেন, সাংগঠনিক সম্পাদক শফিক আদনান, চন্দন ধর ও মশিউর রহমান চৌধুরীসহ দল ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের বড় অংশ দাঁড়িয়েছেন আবদুচ ছালামের পক্ষে। গত ২৫ ডিসেম্বর প্রকাশ্যে সভায় ছালামকে সমর্থন দিয়ে তারা গণসংযোগে নামেন।

আবার নগর আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের একটি ক্ষুদ্র অংশ কাজ করছে জাতীয় পার্টির প্রার্থী সোলায়মান আলম শেঠের সঙ্গে, যার জন্য নৌকার প্রার্থী এ আসনে প্রত্যাহার করা হয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীন সারাবাংলাকে বলেন, ‘চট্টগ্রাম-৮ আসনে নৌকার কোনো প্রার্থী নেই। আওয়ামী লীগের দুজন স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। এ আসন উন্মুক্ত। যে কেউ যে কারও জন্য প্রচার চালাতে পারবেন। আমি বিজয়ের পক্ষে প্রচার করছি। কেউ কেউ ছালাম সাহেবের পক্ষে করছেন।’

ছালামের পক্ষে থাকা নগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি খোরশেদ আলম সুজন সারাবাংলাকে বলেন, ‘ছালাম ও বিজয় দুজনই নগর আওয়ামী লীগের নেতা। সুতরাং যার যেখানে ইচ্ছা যেতে পারেন। আমরা ছালাম সাহেবের পক্ষ নিয়েছি। কারণ উনি এরই মধ্যে সিডিএর চেয়ারম্যান হিসেবে যোগ্যতা প্রমাণ করেছেন। চট্টগ্রামের একটি বড় কাজ এখনো বাকি রয়ে গেছে। সেটা হচ্ছে কালুরঘাট সেতু নির্মাণ। আমরা মনে করি, ছালাম নির্বাচিত হলে কালুরঘাট সেতু বাস্তবায়নে ভূমিকা রাখতে পারবেন।’

নির্বাচন ঘিরে এভাবে নেতাকর্মীদের পাল্টাপাল্টি অবস্থান দলের শৃঙ্খলাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে কি না— জানতে চাইলে খোরশেদ বলেন, ‘এ অবস্থা নির্বাচনের দিন পর্যন্ত থাকবে। এরপর আমরা সবাই আবার আগের মতো এক হয়ে দলের পক্ষে কাজ করব। আশা করি, এটা স্থায়ী বিভক্তিতে রূপ নেবে না।’

সারাবাংলা/আরডি/টিআর

Tags: , , , , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন