বিজ্ঞাপন

আমি কি রকমভাবে বেঁচে আছি (পঞ্চম পর্ব)

April 10, 2024 | 2:24 pm

প্রিন্স আশরাফ

অদ্ভুত চাকরি

বিজ্ঞাপন

শেলীর ফিয়াসের সাথে একই অফিসে তারই অনুকম্পার মধ্যে চাকরি করতে হবে বলে সামিউল এই চাকরি না করার সিদ্ধান্ত নিল। এখনও যা কিছু টাকা আছে তা দিয়ে ঢাকা শহরে টেনেটুনে আরো কয়েকটা মাস চলা যাবে। তারপর জহিরের গেস্ট হিসাবেই পেট চালিয়ে কবিতা লিখতে হবে। আর ছাপা হওয়া দুএকটা গল্প কবিতার সম্মানি দিয়ে হয়তো সিগারেট খরচটা চলবে।
চাকরির জন্য জহির খুব চাপাচাপি করতে লাগল, বুঝতে পারছিল সামি এই চাকরিটা করলে তার উপর চাপ কম থাকবে। তার ব্যবসা এক প্রকার লসেই আছে বলতে গেলে, এখন সাম্উিল যদি লগ্নিকৃত টাকা ফেরত চায় তাহলে কোত্থেকে দেবে? সে সামিউলের রুমে এসে বলল, ‘তুই আরেকটু ভাল করে ভেবে দেখ। এপয়নমেন্ট লেটার তোর হাতে। দুএকদিনের মধ্যেই জয়েন করতে হবে। এরকম হাতের লক্ষ্মী পায়ে ঠেলে দিলে পরে কিন্তু পস্তাতে হবে।’
‘তাই বলে আমি অফিসে গিয়ে বাদল ভাইয়ের জন্য শেলীর কাছে ঘটকালি করব? নিজের প্রেমিকার জন্য ঘটকালি করব?’
‘দরকারে তাই করবি। তুই হবি পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম ব্যক্তি যে প্রেমিকাকে ঘটকালি করে অন্য আরেকজনের হাতে তুলে দেয়।’ জহির হেসে পরিবেশটা তরল করার চেষ্টা করল। ‘আরে ব্যাটা তুই তো আর এখন শেলীর সাথে প্রেম করছিস না, বিয়েও তো করবি না, তাহলে বেচারী যদি অন্য আরেকজনকে খুজে নেয় তাহলে তোর সমস্যা কোথায়?’
সমস্যা কোথায় তা সামিউল নির্দিষ্ট করে বলতে পারছিল না, বুঝতেও পারছিল না। শুধু ভেতরে ভেতরে কেমন যেন একটা অস্বয়োস্তি কাজ করছিল। সত্যিই তো সে শেলীর সাথে আবার নতুন করে প্রেম করতে চায় না, বিয়ে করতে চায় না, তাহলে শেলী বাদল ভাইকে বিয়ে করলে তার অসুবিধে কোথায়?
‘ঠিক আছে, আমি জয়েন করব। কিন্তু কারোর জন্য কোন ঘটকালী করতে পারব না।’ সামিউল যেন জহিরকে নয় নিজেকেই জোরে জোরে কথাটা শোনাল।

অফিসের তিনদিনের ক্রাশ প্রোগ্রাম ট্রেনিং শেষে সামিউলের প্রথম দায়িত্ব পেল। মিরপুর ডিওএইচএসের এক বাসায় বৃদ্ধা মায়ের ছেলে সন্তান হিসাবে সঙ্গ দিতে হবে। বৃদ্ধার একমাত্র ছেলে সন্তান কানাডা প্রবাসি, দেশে আসতে পারে না, বৃদ্ধাও সেখানে যেতে চান না। মেয়েও স্বামীর সাথে বিদেশ প্রবাসি। কারোশি কেয়ারে বৃদ্ধার ছেলেই যোগাযোগ করেছে। বৃদ্ধাকেও জানিয়ে দেওয়া হয়েছে ব্যস্ততার কারণে ছেলের আসার সময় নেই, একজন স্বেচ্ছাসেবক এসে নিসঙ্গ বৃদ্ধাকে সঙ্গ দেবে।
বৃদ্ধার পাচতলার ফ্লাটে এসে সামিউল দেখল ষাটোর্ধ বৃদ্ধা সত্যিই নিসঙ্গ। নিজের সমস্ত কাজ নিজেই করে নেন। একজন ঠিকে বুয়া ঘন্টা দুয়েকের জন্য এসে সব গুছিয়ে টুছিয়ে দিয়ে যায়। আত্মীয় সম্পর্কের অন্য এপার্টমেন্টের একজন ড্রাইভার বাজার সদাই এবং বিশেষ প্রয়োজনে হাসপাতালে টাতালে নিয়ে যায়। কিন্তু বৃদ্ধা এখনও শক্ত সমর্থ আছেন বলেই সাধারণত অন্যের অনুগ্রহ খুব একটা নেন না। নিজের কাজ পারতপক্ষে নিজে করতেই পছন্দ করেন। আর সেজন্যই সামিউলের আগমণও খুব ভাল ভাবে মেনে নিলেন না। শুধুমাত্র ছেলের কাড়িখানিক টাকা খরচ হচ্ছে ভেবেই সামিউলকে দয়া করে একটু সময় দিলেন।
আপন মায়ের সাথে সময় কাটানো আর চাকরির খাতিরে অপরিচিত একজন বৃদ্ধার সাথে সময় কাটানোতে আকাশ পাতাল তফাৎ। প্রথম দিন শুধু বৃদ্ধার বানানো নানান আচার টাচার এসব খেয়েই তার নির্ধারিত সময় কেটে যায়। বৃদ্ধা তাকে ড্রয়িংরুমে বসিয়ে রেখে নিজের সব কাজ সারেন, কিছুক্ষণ টিভি দেখেন, কিছু সেলাই ফোড়ের কাজ করেন, নামাজ শেষ করেন। তার সামনে এসে বসে দুটো কথা বলার ফুরসতই যেন মেলে না। অথচ সামিউল শুনতে পায়, বৃদ্ধা একা বিড়বিড় করে সারাক্ষণ কি জানি বলে। নির্ধারিত সময় শেষ হলে আগামীদিন আসবে জানিয়ে সামিউল বৃদ্ধার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে অফিসে এসে রিপোর্ট করে।
সবশুনেটুনে বাদল ভাই বলেন, ‘প্রথম দিন হিসাবে অন্যদের তুলনায় আপনার পারফর্মমেন্স তাও বেটার। প্রথম প্রথম অনেক বুড়ো বুড়ো কোন সহযোগীতা করে না। আবার অনেকে বকে বকে মাথার পোকা নাড়িয়ে দেয়। আমার প্রাকটিক্যাল অভিজ্ঞতা আছে। এখন আর নিজে য্ইা না, আপনাদের মতো নতুনদের পাঠাই। আপনি আমার কাজটা করে দেন, আপনাকেও বেশি দিন বাসায় বাসায় যেতে হবে না। প্রমোশন দিয়ে অফিস জবে নিয়ে নেবো। কি কাজের কথা বলছি নিশ্চয় বুঝতে পারছেন?’
সামিউল বুঝতে পেরেছে এরকমভাবে মাথা নাড়ে।
বাদল ভাই নিচু গলায় বলল, ‘শেলীর সাথে কি আপনার আর দেখা হয়েছিল?’
‘হ্যা, চাকরি কনফার্ম হলে ধন্যবাদ জানাতে দেখা করতে গিয়েছিলাম।’
‘আমার কথা কিছু বলেছিল নাকি? আমার কথাটা বোধ হয় বলার আর সুযোগ পাননি?’
‘না মানে, ও অফিসের কাজে ব্যস্ত ছিল, তেমন কথাই হয়নি বলতে গেলে।’ সামিউল মিথ্যে করে বলল, ‘একটু সময় সুযোগ পেলেই আপনার কথাটা পাড়ব। আসলে বোঝেন তো, ডিভোর্স হয়ে গেলে আপনা সন্তানের বাবাকে তো আর চ্ইালেই চট করে ভুলে যাওয়া যায় না।’
বাদল ভাই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, ‘হ্যা, সবই বুঝি, বুঝি বলেই তো নিজে বলতে সাহস পাই না। তাতে হিতে বিপরীত হতে পারে। হয়তো রেগেমেগে যেটুকু সম্পর্ক আছে সেটাও ছিন্ন করতে পারে।’
‘আমার মনে হয় ধীরে ধীরে এগুনোই ভাল। ওর মনের ক্ষতে একটু গাঢ় করে প্রলেপ পড়তে দেন।’ সামিউল মুখে এটা বললেও সে চাইছিল না বাদল ভাইয়ের সাথে শেলীর সম্পর্কটা গাঢ় হোক। মানুষের মনোস্তত্ব বড়ো অদ্ভুত। নতুন করে শেলীকে দেখে সামিউলের প্রেম উৎলে ওঠেনি, বরং কেমন যেন ভাটা পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু এখন বাদল ভাইয়ের অতি আগ্রহের কারণে তার মধ্যে আবার যেন প্রেম জাগতে শুরু করেছে। প্রেম কি বেশি প্রতিদ্বন্দী পছন্দ করে?
বাদল ভাই বলল, ‘ঠিক আছে, আমি শেলীর সাথে স্বাভাবিক সম্পকর্টা বজায় রাখছি। আপনি শুধু আমার দিকটা একটু দেখবেন। আমিও আপনার দিকটা দেখব।’ বাদল ভাই মিটিং শেষ করার ইঙ্গিত দিলেন, ‘ও ভাল কথা, আপনি এই ক্লায়েন্টের কাছে আরো কয়েকটা দিন যান, তারপর দেখি আপনার জন্য একজন ভাল ক্লায়েন্ট দিতে পারি কিনা। আমাদের এক পুরানো ক্লায়েন্ট আছে, বৃদ্ধ। তার ওখানে যে ছেলেটা যেতো, সে কি কারণে জানি চাকরি ছেড়ে দিয়ে চলে গেছে, ওই ক্লায়েন্টের কাছেও যাচ্ছে না, আমাদের অফিসেও কোন যোগাযোগ করেনি। মোবাইল নাম্বারও বন্ধ করে রেখেছে। রাকিবের কোন হদিসই পাওয়া যাচ্ছে না। ওখানেই আপনাকে রিক্রুট করে দেবো। ওই বৃদ্ধ এই প্রক্রিয়ায় অভ্যস্ত!

মিরপুর ডিওএইচএসের বৃদ্ধা দুইদিনের মধ্যেই সামিউলের সাথে বেশ সহজ হয়ে গেলেন। এমনকি এরকম বকাবকি আর খাতিরযত্ন শুরু করলেন যে সামিউলের মনে হলো আগেই তো ভাল ছিল। ছেলেমেয়েদের কি কষ্ট করে মানুষ করেছেন, টাকা পয়সার জমানো গাড়ি বাড়ি না করে ছেলেমেয়েদের উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন, এখন তাদের পরিচয় দিতে গর্বে বুক ফুলে ওঠে। নিজেরা গাড়ি বাড়ি করতে না পারলেও ছেলেমেয়ে সবারই গাড়ি বাড়ি আছে, কেউ অধ্যাপক, কেউ পিএইচডি, এইসব ফিরিস্তি আর কি! সেই সাথে সামিউলকে পেয়েই কিনা কে জানে, বৃদ্ধার খাওয়ানোর পালা শুরু হলো। এই ছেলে টেংরা মাছ দিতে ডাটা শাক খেতে ভালবাসত, সেই রান্না খেতে হয় সামিউলকে, বৃদ্ধার রান্নায় ঝাল লবন কম, তাছাড়া সামিউল কোন সময়ই খেতে পছন্দ করে না, বৃদ্ধার চক্করে পড়ে সেইসব খানা খাদ্যও খেত হতে লাগল তাকে।
অফিসে ফিরতেই বাদল ভাই জানালেন, ‘আপনার জন্য একটা সুখবর আছে।’ বলে একটু অপেক্ষা করলেন।
সামিউলের স্বভাবই যেচে জিজ্ঞেস না করা, সে জিজ্ঞেস না করে বাদল ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
‘সুখবরটা হলো, ওই যে বৃদ্ধের কথা বলেছিলাম না একদিন, ওখান থেকে ডাক এসেছে। বৃদ্ধ খুব ফ্রেন্ডলি। আপনি আপনাকে ওখানেই রিক্রুট করে দিয়েছি। আপনি এখন চাইলে মিরপুর ডিওএইচএসেরটা অন্য কাউকে দিয়ে দিতে পারেন।’
আরেকজন নতুন বৃদ্ধের ওখানে যেয়ে একইরকম বকাবকানি শুনতে হবে, এটা সামিউলের জন্য কিভাবে সুখবর হয় তা সে বুঝতে পারল না। মিরপুর ডিওএইচএসের ওই বৃদ্ধাও এখন তার যেন অনেকখানি আপন হয়ে গেছে, যদিও কিছুটা ভালবাসার অত্যাচার সহ্য করতে হয়। তারচেয়ে বড়ো কথা, এই বৃদ্ধের ব্যাপারে তার মন ঠিক সায় দিচ্ছে না। তার ভূতপূর্ব কলিগ নাজমুল কেন বৃদ্ধের ওখান থেকে শুধু কেটেই পড়ল না, চাকরিও ছেড়ে দিল, এই রহস্যময় কারণ সে বুঝতে পারছিল না। একজন মানুষ চাকরি ছেড়ে দিলেও কেন আর অফিসে যোগাযোগ করবে না, বকেয়া পাওনা নিয়ে যাবে না, এরকম বেমালুম লাপাত্তা হয়ে যাবে, সামিউলের মধ্যে এক ধরণের সংশয় কাজ করছিল।

বিজ্ঞাপন

চলবে…

সারাবাংলা/এসবিডিই

Tags: , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন