বিজ্ঞাপন

এসেছে জলভরা মেঘের আষাঢ়

June 15, 2018 | 12:22 pm

।। এসএম মুন্না।।

বিজ্ঞাপন

ঢাকা : তপ্ত গ্রীষ্ম শেষে বর্ষার বার্তা নিয়ে আবার এলো আষাঢ়। আজ আষাঢ়ের প্রথম দিন। ঋতুবৈচিত্র্যের পালাবদলে শুরু হয়েছে বর্ষাকাল। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আষাঢ়ের বন্দনায় বলেছেন_ ‘আষাঢ়, কোথা হতে আজ পেলি ছাড়া।/ মাঠের শেষে শ্যামল বেশে ক্ষণেক দাঁড়া ।। / জয়ধ্বজা ওই-যে তোমার গগন জুড়ে।/ পুব হতে কোন্ পশ্চিমেতে যায় রে উড়ে…।’ দাবদাহে হাঁসফাঁস মানুষ কবির মতোই মনে করছে, জলভরা মেঘের আষাঢ় এসেছে দীর্ঘ তাপদহনের জ্বালা-যন্ত্রণার গ্রীষ্মের যবনিকা টানতে। মুক্তি পেতে চলেছে প্রখর দাবদাহে কাহিল মানবকুল, প্রকৃতি ও উদ্ভিদরাজি।

বর্ষায় যদিও টানা বর্ষণের কারণে জনচলাচলে বিঘ্ন, জলাবদ্ধতা, যানজটে দীর্ঘক্ষণ আটকে থাকার অস্বস্তিকর দুর্ভোগ সহ্য করতে হয়; তার পরও মানুষ প্রতীক্ষা করে বর্ষার। তাপদহনের হাঁসফাঁস থেকে মুক্তির জন্য তারা মেনে নেয় বর্ষার নানা দুর্ভোগ। বর্ষায় প্রকৃতির শ্যামল বৃক্ষ ও উদ্ভিদরাজি সতেজ ঝলমলে হয়ে ওঠে। মৌসুমি বাহারি ফল-ফুলের ঘ্রাণে ম-ম করে চারপাশ।

আবহাওয়া অফিস বলছে, এবার আগে-ভাগেই চলে এসেছে বর্ষা। কয়েক দিন আগেও খুব ঝরেছে বৃষ্টি। যদিও গ্রীষ্মের শেষদিন বৃহস্পতিবার তপ্ত ছিল। এবারের বর্ষায় আষাঢ় ও শ্রাবণ দুই মাসজুড়েই থেকে থেকে বৃষ্টি হতে পারে, টানা বৃষ্টিও হতে পারে যে-কোনো সময়। অতিবৃষ্টির ফলে জনজীবনে বিপত্তিও ঘটতে পারে। কারণ, দিন আনা-দিন খাওয়া মানুষের কাজে ছন্দপতন ঘটায় অবিরাম বর্ষণ। তবে বিপত্তি ও দুর্যোগের পরও বর্ষাকাল কৃষিভিত্তিক এই জনপদের জন্য আশীর্বাদ।

বিজ্ঞাপন

বর্ষার কথা এলেই চোখের সামনে যে চিত্রটি ভেসে ওঠে, তা হলো টানা তিন-চারদিনের বর্ষণে খাল-বিল, নদী-নালা উপচানো জলস্রোত, রাস্তাঘাটে জলাবদ্ধতা, প্যাচপেচে কাদা, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, বন্যার ভয়াবহ ছোবল ইত্যাদি।

মহাকবি কালিদাস তার মেঘদূত কাব্যে আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে বিরহ কাতর ‘যক্ষ মেঘ’কে দূত করে কৈলাশে পাঠিয়েছিলেন তার প্রিয়ার কাছে। যক্ষের সে বিরহ বারতা মেঘদূত যেন সঞ্চারিত করে চলেছে প্রতিটি বিরহ কাতর চিত্তে, যুগ হতে যুগান্তরে। তিনি বলেন, মেঘ দেখলে সুখি মানুষও আনমনা হয়ে যায়। তার ভাষায় ‘পুব-হাওয়াতে দেয় দোলা আজ মরি মরি।/হৃদয়নদীর কূলে কূলে জাগে লহরী।/ পথ চেয়ে তাই একলা ঘাটে বিনা কাজ সময় কাটে,/পাল তুলে ওই আসে তোমার সুরেরই তরী\\’ (শেষ বর্ষণ)।

বিজ্ঞাপন

তারপরও বর্ষা বর্ষাই। বাংলাদেশ ষড়ঋতুর দেশ হলেও তিনটি ঋতু তাদের অস্তিত্ব জানান দেয় প্রবলভাবে। তার মধ্যে বর্ষা একটি।

আদিকাল থেকেই বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির বিভিন্ন শাখায় বর্ষা ঋতু নিয়ে রয়েছে উচ্ছ্বসিত বন্দনা, অনুরাগ ও স্তুতি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কালোত্তীর্ণ রচনাসম্ভারে বর্ষা দখল করে আছে উল্লেখযোগ্য স্থান। বর্ষা ছিল কবির প্রিয় একটি ঋতু। তার বিভিন্ন গানে আছে মেঘ-মেদুর বর্ষার রূপ-ঐশ্বর্যের শিল্পিত বর্ণনা। বর্ষায় কবিগুরুর বাউল হৃদয় ময়ূরের মতো নেচে উঠত। তাই তিনি গেয়েছেন, ‘হৃদয় আমার নাচেরে আজিকে, ময়ূরের মতো নাচেরে, আকুল পরান আকাশে চাহিয়া উল্লাসে কারে যাচে রে..।’

রবীন্দ্রনাথ আরও লিখেছেন, ‘এসেছে আষাঢ় আকাশ ছেয়ে/আসে বৃষ্টির সুবাস বাতাস বেয়ে/এই পুরাতন হৃদয় আমার আজি/পুলকে দুলিয়া উঠিছে আবার বাজি/নূতন মেঘের ঘনিমার পানে চেয়ে/রহিয়া রহিয়া বিপুল মাঠের পরে/ নব তৃণদলে বাদলের ছায়া পড়ে/‘এসেছে এসেছে’ এই কথা বলে প্রাণ, ‘এসেছে এসেছে’ উঠিতেছে এই গান/নয়নে এসেছে, হৃদয়ে এসেছে ধেঁয়ে।…’

বিজ্ঞাপন

প্রকৃতির কবি জীবনানন্দ দাশ আষাঢ়কে বলেছেন, ‘ধ্যানমগ্ন বাউল-সুখের বাঁশি।’ আষাঢ়ে জলভারানত ঘনকৃষ্ণ মেঘরাশি আকাশ ছেয়ে রাখে। কখনো বা ‘প্রাণনাথে’র মতো প্রকৃতিতে নামে বারিধারা। আষাঢ়ে প্রকৃতি ‘সজল শ্যাম ঘন দেয়া’কে সম্ভাষণ। রূপ-রঙে হয়ে ওঠে ঢল ঢল। আকুতি জানায়-বারিধারে এসো চারিধার ভাসায়ে, বিদু্যুৎ ইঙ্গিতে দশদিক হাসায়ে।’

তাপদাহে চৌচির মাঠ-ঘাট খাল-বিল বনবিথিকায় জেগে ওঠে নবীন প্রাণের ছন্দ এই বর্ষায়। থৈ থৈ পানিতে আবহমান বাংলার রূপ হয় অপরূপ রূপবতী সলিল দুহিতা। বর্ষার সৌন্দর্যে বিমোহিত মধ্যযুগের কবি জয়দেবের কণ্ঠে তাই ধ্বনিত হয়েছে-‘মেঘৈর্মে দুরম্বরং,বণভুব শ্যামাস্ত মালদ্রুমৈ…।’

আষাঢ়-শ্রাবণ দুই মাস বর্ষাকাল। তবুও কর্মহীন দিবস রজনী, উদাস মনের তোলপাড়, তপ্ত দীর্ঘশ্বাস আর ‘দু’জনে মুখোমুখি গভীর দুঃখে দুঃখি..’ বর্ষাকে দেয় এক ভিন্নমাত্রা। গ্রীষ্মের অগ্নিঝরা দিনগুলো যখন প্রকৃতিকে করে বিবর্ণ ও শুষ্ক এবং জনজীবনকে করে অসহনীয়, তখনই বর্ষা রিমঝিম বৃষ্টি ঝরিয়ে প্রকৃতিকে করে তোলে সজীব। বর্ষার মুষলধারার বৃষ্টিতে ভেজার জন্য তাই তৃষিত অপেক্ষাতুর প্রকৃতি উন্মুখ হয়ে আছে।

বর্ষাকে অভিহিত করেন ‘সেকেন্ড সামার’ হিসেবে। অর্থাৎ, গরম থেকে জনজীবনের রেহাই নেই। বৃষ্টি হলেও ভাপসা গরমের অস্বস্তি মানুষকে ঠিকই ভোগায়। আবার মৌসুমি বায়ু প্রবাহের কারণে টানা দুই মাস থেমে থেমে বৃষ্টিপাত, প্রকৃতি অন্যরকম এক আদলে আমাদের সামনে উপস্থিত হয়। তবুও বর্ষাই ঋতুর রানী।

‘বাদল-দিনের প্রথম কদম ফুল করেছ দান/আমি দিতে এসেছি শ্রাবণের গান’ বর্ষা নিয়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই আবেগময়, প্রেমসিক্ত গান শুধু বাঙালিদের জন্যই প্রযোজ্য। শুধু রবীন্দ্রনাথই নন, বাংলা সাহিত্যের খ্যাত-অখ্যাত বহু কবিই বর্ষার রূপ-ঐশ্বর্যে মোহিত ও মুগ্ধ, বর্ষার আবাহনে উচ্ছ্বসিত ও মুখর।

বর্ষাবিহীন বাংলাদেশ ভাবাই যায় না। বর্ষা ঋতু তার বৈশিষ্ট্যের কারণে স্বতন্ত্র। বর্ষা ঋতু কাব্যময়, প্রেমময়। বর্ষার প্রবল বর্ষণে নির্জনে ভালোবাসার সাধ জাগে, চিত্তচাঞ্চল্য বেড়ে যায়। শত অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার ভিড়েও কোথায় যেন মেলে এক চিলতে বিশুদ্ধ সুখ। কদম ফুলের মতো তুলতুলে নরম, রঙিন স্বপ্ন দুই চোখের কোণে ভেসে ওঠে, ঠিক যেমন করে আকাশে সাদা মেঘ ভেসে বেড়ায়।

রহস্যময়ী বর্ষার রূপ-বৈচিত্র্য, চমক, বর্ণচ্ছটা ও আকাশ-প্রকৃতির গভীর মিতালি শিল্প-সাহিত্যের উপকরণ হিসেবেও আবহমানকাল থেকে শিল্পী-কবি-সাহিত্যিকদের অনুপ্রাণিত ও স্পন্দিত করে আসছে। কবির কবিতায়, শিল্পীর সুরে-গানে, চারুশিল্পীর তুলির আঁচড়ে, চলচ্চিত্রের সেলুলয়েডে, নকশীকাঁথার ফোঁড়ে ফোঁড়ে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সমৃদ্ধ ভাণ্ডারে বর্ষার অপরূপ রূপ বর্ণনা, স্থিতি ও ব্যাপ্তি মূর্ত ও চিরকালীন হয়ে আছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গীত ও কবিতার ভাষায় ‘নীল নবঘনে আষাঢ় গগনে তিল ঠাঁই আর নাহি রে।/ওগো আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে।/বাদলের ধারা ঝরে ঝরো ঝরো, আউশের ক্ষেত জলে ভরো-ভরো,/কালিমাখা মেঘে ওপারে আঁধার ঘনিয়েছে দেখ চাহি রে…।’

বর্ষা ফুল ফোটায়। বর্ষার এই শীতল আবহাওয়ায় গাছে গাছে কদম ফুলের সমারোহ দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। বর্ষার প্রথম মাস আষাঢ়ের অগ্রদূত কদম ফুল। যেন কদম ফুল আষাঢ়কে স্বাগত জানায়। এই বর্ষাতেই ফোটা কেয়া, চালতা ফুলের শুভ্রতা আর সজীবতা দৃষ্টি কেড়ে নেয়। ফোটে কামিনী, মালতি, কণকচাঁপা, বেলিসহ আরও নানা রকম মৌসুমি ফুল। যদিও বর্ষার আগেই গাছে গাছে কদম ফুল ফুটেছে।

বর্ষা মাটিকে উর্বর করে, বৃক্ষকে সজীব করে, নতুন প্রাণকে বিরূপ প্রতিবেশেও টিকে থাকার শক্তি জোগায়, ফসলকে সমৃদ্ধ করে। বর্ষা তাই বর্ষাই চরিত্র, বৈশিষ্ট্য ও রূপের বর্ণচ্ছটায় এটি তুলনারহিত ঋতু। যদিও নগরে ও নাগরিক জীবনে সে প্রতি পদে বিপত্তি ঘটায়। যে কারণে বাংলা ভাষার অন্যতম কবি শহীদ কাদরী বৃষ্টির ঘনঘটা দেখতে দেখতে লিখে গেছেন, ‘সহসা সন্ত্রাস ছু’লো/ … হাওয়া, ময়ূরের মতো তার বর্ণালী চিৎকার/ কী বিপদগ্রস্ত ঘর-দোর/ ডানা মেলে দিতে চায় জানালা-কপাট/ নড়ে ওঠে টিরোনসিরসের মতন যেন প্রাচীন এ-বাড়ি/ জলোচ্ছ্বাসে ভেসে যায় জনারণ্য, শহরের জানু/ আর চকচকে ঝলমলে বেসামাল এভিনিউ।’  কখনও কখনও বন্যাও ছোবল মারে এই বর্ষায়।

সারাবাংলা/একে

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন