বিজ্ঞাপন

শুটার আকাশের একটাই প্রশ্ন— আমাকে ধরলেন কীভাবে!

March 27, 2022 | 10:57 pm

উজ্জল জিসান, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: মতিঝিল আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম টিপুকে গুলি করেই গা ঢাকা দেন মাসুম মোহাম্মদ আকাশ। ঢাকা ছেড়ে পাড়ি জমান জয়পুরহাটে। লক্ষ্য ছিল ভারতে পালিয়ে যাওয়া। কিন্তু সেটি সম্ভব না হওয়ায় পালিয়ে যান বগুড়ায়। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিতে পারেননি। ঘটনাস্থলের আশপাশের ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরার (সিসি ক্যামেরা) ফুটেজ বিশ্লেষণ করে শনাক্ত করা হয় আকাশকে। তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার করে তার অবস্থানও চিহ্নিত করা হয়। শেষ পর্যন্ত বগুড়াতেই গোয়েন্দা পুলিশের হাতে ধরা পড়েন আকাশ।

বিজ্ঞাপন

পুলিশ জানাচ্ছে, আকাশ চার-পাঁচটি মামলার আসামি। ফেরার ছিলেন তিনি। তবে এভাবে যে পুলিশের হাতে ধরা পড়বেন, সেটি তার চিন্তাতেও আসেনি। ভেবেছিলেন, এবারও পার পেয়ে যাবেন। সেটি হয়নি বলে বিস্মিতও হয়েছেন। তাকে গ্রেফতার করে ঢাকায় নিয়ে আসার পর গোয়েন্দা পুলিশের কাছে সারারাত একটি প্রশ্নই করেছেন— আমাকে গ্রেফতার করলেন কীভাবে!

গত বৃহস্পতিবার (২৪ মার্চ) রাতে রাজধানীর শাহজাহানপুরে মতিঝিল আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম টিপুকে গুলি করে হত্যা করা হয়। মাইক্রোবাস নিয়ে যানজটে আটকা পড়েছিলেন টিপু। তাকে লক্ষ্য করে যে কয়েক রাউন্ড গুলি করা হয়, তার একটি গিয়ে লাগে টিপুর গাড়ির পাশেই রিকশায় থাকা কলেজছাত্রী সামিয়া আফনান প্রীতির। টিপুর মতো গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারান তিনিও। টিপুর গাড়িচালক মনির হোসেন মুন্না (২৬) গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

এ ঘটনার পর নড়েচড়ে বসে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। আশপাশের এলাকার সব সিসি ক্যামেরার ফুটেজ নিয়ে চলে চুলচেরা বিশ্লেষণ। তার সূত্র ধরেই শনাক্ত করা হয় শুটার আকাশকে। চিহ্নিত করা হয় তার অবস্থানও। শেষ পর্যন্ত শনিবার (২৬ মার্চ) বগুড়া থেকে তাকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। নিয়ে আসা হয় ঢাকায়। শনিবার রাতভর তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এসময় আকাশ স্বীকার করে নেন, তিনিই গুলি করেছেন টিপু ও প্রীতিকে।

বিজ্ঞাপন

আরও পড়ুন-

রোববার (২৭ মার্চ) ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলন শেষে ডিবি কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপে এসব তথ্য উঠে এসেছে। এসময় ডিবি কর্মকর্তারা জানান, রাতভর জিজ্ঞাসাবাদে আকাশ নানা প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। তবে তিনি নিজে ঘুরেফিরে ডিবিকে বলেন একটাই কথা— ‘আমাকে গ্রেফতার করলেন কীভাবে? এখন পর্যন্ত কোনো মামলায় কেউ আমাকে গ্রেফতার করতে পারেনি। আমাকে ধরলেন কীভাবে, সেটাই আমি বুঝে উঠতে পারছি না।’

বিজ্ঞাপন

আকাশকে গ্রেফতারের অভিযানে থাকা ডিবির একজন কর্মকর্তা বলেন, ঘটনার পাঁচ দিন আগে ‘কন্ট্রাক্ট কিলিং’য়ের দায়িত্ব পান মাসুম মোহাম্মদ আকাশ (৩৪)। কাকে হত্যা করতে হবে, সেই নাম পান তিন দিন আগে। একই দিন তাকে সরবরাহ করা হয় অস্ত্র ও গুলি। পরিকল্পনা অনুযায়ী তিনি ‘কিলিং মিশন’ এমনভাবে শেষ করেন যে তাকে শনাক্ত করাই ছিল চ্যালেঞ্জিং। এর জন্য মুখে মুখোশের পাশাপাশি মাথায় পরেছেন হেলমেট। পোশাক আর জুতাও ব্যবহার করেছেন তার স্বাভাবিক ব্যবহারের বাইরের। কিন্তু গ্রেফতার এড়াতে পারেননি আকাশ।

ডিবির ওই কর্মকর্তা বলেন, ঘটনার আগের দিন (২৩ মার্চ) সন্ধ্যায় মতিঝিলে টিপুর মালিকাধীন হোটেলের পাশে এক সহযোগীকে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন মাসুম মোহাম্মদ আকাশ। ঘটনার সময়কার তো বটেই, আশপাশের এলাকার এর আগের কয়েকদিনেরও সিসি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ করা হয়। তা থেকেই শনাক্ত হয় আকাশকে। এটিই আকাশ বুঝতে পারেননি।

মাসুম আকাশ ডিবিকে বলেন, আমার নামে যেসব মামলা রয়েছে সেগুলোতে পুলিশ কোনোদিনই আমাকে গ্রেফতার করতে পারেনি। এ ঘটনাতেও নিশ্চিত ছিলাম, কেউ আমাকে গ্রেফতার করতে পারবে না। কারণ সবকিছু সেভাবেই সেট করা ছিল। গ্রেফতার এড়াতে বাড়তি নিরাপত্তাব্যবস্থা হিসেবে ভারতে যেতে চেয়েছিলাম। এর জন্য সীমান্ত পাড়ি দিতে আগের দিন (২৫ মার্চ) জয়পুরহাটে যাই। লাইন ঠিক না থাকায় সেদিন পার হতে পারিনি। শনিবার বিকেলে ভারতে যাওয়ার কথা ছিল। এর মধ্যে গ্রেফতার এড়াতে ছোট শহর ছেড়ে একটু বড় শহরে (বগুড়ায়) আসি। সেখানেই আমাকে পুলিশ গ্রেফতার করে।

বগুড়া থেকে মাসুম মোহাম্মদ আকাশকে গ্রেফতার করে ঢাকায় নিয়ে আসে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ

ডিবি কর্মকর্তা বলেন, বগুড়ার হোটেলে আকাশ আমাদের দেখে অবাক হয়ে যান। হতভম্বের মতো তিনি আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকেন। এক পর্যায়ে বলেই ফেলেন, আমার খোঁজ কীভাবে পেলেন আপনারা? এরপরই গুলি করার কথা স্বীকার করেন মাসুম।

বিজ্ঞাপন

এর আগে, ডিবি প্রধান পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার এ কে এম হাফিজ আকতার সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ডিবি সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদে আকাশ জানিয়েছেন, তার একমাত্র টার্গেট ছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুল ইসলাম টিপু। গুলি করার আগেই পিস্তলের ট্রিগার চেপে ধরে রেখেছিলেন। ফলে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই বেশ কয়েক রাউন্ড গুলি বের হয়। সেই গুলিতে টিপুর সঙ্গে নিহত হন রিকশাআরোহী সামিয়া আফনান জামাল প্রীতি। এরপর সহযোগীর সঙ্গে মোটরসাইকেলে পালিয়ে যান আকাশ। গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রীতির মৃত্যুর খবর আকাশ পরে জানতে পেরেছেন বলে জানিয়েছেন আকাশ।

আকাশকে গ্রেফতার করলেও তার ব্যবহৃত পিস্তলটি এখনো উদ্ধার হয়নি। এক্ষেত্রে আকাশের পরিচয় শনাক্তের বিষয়ে জানতে চাইলে ডিবি প্রধান বলেন, অস্ত্র একটি ঘটনার আলামত মাত্র। ওই ঘটনার পাঁচ-ছয় ঘণ্টার মধ্যেই আমরা তথ্য-উপাত্ত নিয়ে কাজ শুরু করি। এরপর ঘটনার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেফতার করি প্রধান আসামিকে। একটি কিলিং হওয়ার পরে সমাজে অস্থিরতা বিরাজ করে। আমরা রাত-দিন কাজ করে সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে আসামিকে ধরেছি। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আসামিও ঘটনা স্বীকার করেছেন। এছাড়া আসামি সীমান্ত দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।

ঢাকা সেন্ট্রাল ডিপো থেকে আকাশ কাট-আউট সিস্টেমে একটি মোটরসাইকেল ও একটি পিস্তল ব্যাগে করে নিয়ে যান— এ তথ্য জানিয়ে হাফিজ আক্তার বলেন, মাসুমের সঙ্গে আরেকজন ছিলেন। অর্থাৎ হত্যাকাণ্ডে দু’জন অংশগ্রহণ করেন। দ্বিতীয় ওই ব্যক্তি মোটরসাইকেলটি চালাচ্ছিলেন। তদন্তের স্বার্থে তার নাম এখনই প্রকাশ করা যাবে না।

টিপু হত্যাকাণ্ড রাজনৈতিক নাকি স্রেফ সন্ত্রাসী কিলিং মিশন— এমন প্রশ্নের জবাবে এ কে এম হাফিজ আকতার বলেন, আমরা তিন-চারটি বিষয় নিয়ে আগাচ্ছি। রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড নাকি কেবলই সন্ত্রাসী হামলা— আরও তদন্তের পর সে বিষয়ে জানা যাবে।

ডিবি প্রধান জানান, গ্রেফতার আকাশ হতাশাগ্রস্ত ছিলেন। তার বিরুদ্ধে চার-পাঁচটি মামলা রয়েছে। সেসব মামলার ফেরারি আসামি তিনি। এ কারণে বাড়িতে যেতে পারতেন না। তবে তার দেওয়া সব তথ্য সত্য— এমনটিও নয়। তদন্তের পর এসব বিষয় নিয়ে বিস্তারিত জানা যাবে।

জাহিদুল ইসলাম টিপুকে হত্যার ঘটনায় পরদিন শুক্রবার (২৫ মার্চ) দুপুরে তার স্ত্রী ফারজানা ইসলাম ডলি বাদী হয়ে শাহজাহানপুর থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলায় অজ্ঞাতনামা কয়েকজনকে আসামি করা হয়। তবে এ ঘটনায় নিহত কলেজছাত্রী প্রীতির পরিবারের পক্ষ থেকে কোনো আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

সারাবাংলা/ইউজে/টিআর

Tags: , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন