Saturday 07 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

অর্থবছরের জন্য ৬ চ্যালেঞ্জ, বাজেটে উত্তরণে প্রত্যয়ী অর্থমন্ত্রী

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
৯ জুন ২০২২ ২২:২০

২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট পেশ করছেন অর্থমন্ত্রী

ঢাকা: বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের সংক্রমণ অনেকটাই বাংলাদেশ কাটিয়ে উঠেছে বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। তবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে সারাবিশ্বের মতো বাংলাদেশও অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে তিনি জানিয়েছেন। চলমান প্রেক্ষাপটে আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য ছয়টি বিষয়কে প্রধান চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করেছেন অর্থমন্ত্রী। সেসব চ্যালেঞ্জ মাথায় রেখেই এই অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেট প্রণয়ন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি। বলেছেন, জনগণকে সঙ্গে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এসব চ্যালেঞ্জ উৎরে যেতে পারবেন।

বৃহস্পতিবার (৯ জুন) জাতীয় সংসদে ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট উত্থাপনের সময় বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী এসব কথা বলেন। স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে সংসদ নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতি বাজেট অধিবেশনের কার্যক্রম পরিচালিত হয়।

বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী জানান, বাজেট প্রণয়নের আগে অর্থনীতিবিদ ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে সংলাপ করেছেন তিনি। এছাড়া মন্ত্রণালয়সহ সরকারের বিভিন্ন দফতর এবং বিভিন্ন সংগঠন থেকেও বাজেটের ওপর প্রস্তাবনা পেয়েছেন। এসব আলোচনা, প্রস্তাবনা ও নিজেদের বিশ্লেষণ থেকে আগামী অর্থবছরের জন্য প্রধান ছয়টি চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করা হয়েছে বলে জানান তিনি। এই চ্যালেঞ্জগুলো হলো—

১. মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা ও অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ বাড়ানো;

২. গ্যাস, বিদ্যুৎ ও সারের মূল্য বেড়ে যাওয়ার কারণে বর্ধিত ভর্তুকির জন্য অর্থের সংস্থান;

৩. বৈদেশিক সহায়তার অর্থ ব্যবহার এবং মন্ত্রণালয়/বিভাগের উচ্চ-অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত প্রকল্পগুলো নির্ধারিত সময়ে শেষ করা;

৪. শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের প্রকল্পগুলো যথাসময়ে বাস্তবায়ন;

৫. অভ্যন্তরীণ মূল্য সংযোজন কর সংগ্রহের পরিমাণ ও ব্যক্তি আয়করদাতার সংখ্যা বাড়ানো; এবং

৬. টাকার বিনিময় হার স্থিতিতিশীল ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সন্তোষজনক পর্যায়ে রাখা।

এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কৌশলী হতে হবে জানিয়ে বাজেটে বেশকিছু পদক্ষেপ স্থান পেয়েছে বলে জানান অর্থমন্ত্রী। বাজেট বক্তৃতায় তিনি বলেন, কোনো একটি সমস্যাও সঠিকভাবে সমাধান করা না গেলে তা সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা বিনষ্ট করতে পারে। আমাদের মূল কৌশল হবে বিদ্যমান চাহিদার প্রবৃদ্ধি কমিয়ে সরবরাহ বাড়ানো। সে লক্ষ্যে আমদানিনির্ভর ও কম গুরুত্বপূর্ণ সরকারি ব্যয় বন্ধ রাখা অথবা কমানো হবে। নিম্ন অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়নের গতি কমানো হবে এবং একই সময়ে উচ্চ ও মধ্যম অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত করা হবে। জ্বালানি তেল, গ্যাস, বিদ্যুৎ ও সারের বিক্রয়মূল্য পর্যায়ক্রমে ও স্বল্প আকারে সমন্বয় করা হবে।

আরও পড়ুন-

ছয় চ্যালেঞ্জ উত্তরণে আরও যেসব পদক্ষেপ বাজেট প্রস্তাবনায় রাখা হয়েছে, তার কথা তুলে ধরে অর্থমন্ত্রী বলেন, কার্যক্রম জোরদার করার লক্ষ্যে কর সংগ্রহে অটোমেশন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হবে। মূল্য সংযোজন কর ও আয়করের জাল বিস্তৃত করা হবে। বিলাসী ও অপ্রয়োজনীয় আমদানি নিরুৎসাহিত করা হবে। আন্ডার ও ওভার ইনভয়েসিংয়ের বিষয়টি সতর্ক পর্যবেক্ষণে রাখা হবে। মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিয়ম হার প্রতিযোগিতামূলক রাখা হবে।

সাধারণ মানুষের ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি এবং দৃঢ় ও সাহসী নেতৃত্বকেই দেশের অর্থনীতির প্রাণশক্তি হিসেবে বাজেট বক্তৃতায় আখ্যা দেন মুস্তফা কামাল। তিনি বলেন, সঙ্গত কারণেই কোভিড-১৯ ও ইউক্রেন যুদ্ধ উদ্ভূত অর্থনৈতিক প্রভাব মোকাবিলা করে দেশের সব স্তরের জনগণের জীবন-জীবিকা এবং সর্বোপরি ব্যাপক কর্মসৃজন ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এনে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখা এবারের বাজেটে প্রাধান্য পাবে।

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামালকে নিয়ে সংসদ অধিবেশন কক্ষের দিকে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ যেভাবে মোকাবিলা করা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আগামী অর্থবছরেও ইউক্রেন সংকট উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলা করে দেশের উন্নয়নের ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ন রাখা হবে বলে মন্তব্য করেন অর্থমন্ত্রী।

এর আগে, ‘বৈশ্বিক সংকট ও বাংলাদেশের জন্য চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক বাজেট  বক্তৃতার চতুর্থ অধ্যায়ের শুরুতেই দেশের অর্থনীতিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের বিভিন্ন ধরনের প্রভাবের কথা তুলে ধরেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। বলেন, পশ্চিমা দেশগুলো কর্তৃক আন্তর্জাতিক পেমেন্ট নেটওয়ার্ক সুইফট থেকে রাশিয়াকে বিচ্ছিন্ন করায় আমদানি-রফতানি বাণিজ্য সংকুচিত হয়ে আসছে, যা বৈশ্বিক সাপ্লাই চেইনকে ব্যাহত করছে। রাশিয়া-ইউক্রেন সংকট দীর্ঘস্থায়ী হলে তা বৈশ্বিক অর্থনীতির কোভিড-পরবর্তী পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করবে।

আরও পড়ুন-

এসময় বাজেট বক্তৃতায় আন্তর্জাতিক পর্যায়ে জ্বালানি ও ভোজ্যতেল, ইউরিয়া সার, গম ও চিনির দাম বেড়ে যাওয়ার তথ্য তুলে ধরেন অর্থমন্ত্রী। তিনি জানান, আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ার পূর্বাভাস দিয়েছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও ‍কৃষি বিষয়ক সংস্থা ২০২১ সালের মতো ২০২২ সালেও খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির ইঙ্গিত দিয়েছে।

এ প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে ‘ইমপোর্টেড ইনফ্লেশন’ হিসেবে অভ্যন্তরীণ বাজারের মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখাকে দেশের বর্তমান অর্থনীতির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে অভিহিত করেন মন্ত্রী। তিনি বলেন, এ পরিস্থিতিতে সরকারের ভর্তুকি ব্যবস্থাপনার ওপরও চাপ তৈরি হয়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে ভর্তুকি ও প্রণোদনা বাবদ ব্যয় প্রাক্কল ছিল ৫৩ হাজার ৮৫২ কোটি টাকা। পরে মূল্যবৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে সংশোধিত বাজেটে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৬৬ হাজার ৮২৫ কোটি টাকায়। আর ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ভর্তুকির প্রাক্কলন করা হয়েছে ৮২ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা। আন্তর্জাতিক বাজারের চলমান পরিস্থিতিতে এই ভর্তুকি আরও ১৫ থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে বলেও বাজেট বক্তৃতায় উল্লেখ করেন আ হ ম মুস্তফা কামাল।

এসময় অর্থমন্ত্রীর হাতে ছিল বাজেট সংক্রান্ত বিভিন্ন নথির ব্রিফকেস

দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক দশা তুলে ধরে অর্থমন্ত্রী জানান, ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রবাসীদের কাছ থেকে রেকর্ড রেমিট্যান্স এসেছিল। বর্তমানে তাতে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। বিপরীতে কোভিড পরবর্তী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে গতি থাকায় আমদানি ব্যয়ও রেকর্ড পরিমাণে বেড়েছে। তাতে ডলারের চাহিদা বেড়েছে। তাতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলার থেকে কমে ৪২ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। ২০২১ সালের জুলাই থেকে এ বছরের ৬ জুন পর্যন্ত ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে ৭ দশমিক ৯ শতাংশ। তাই আগামী অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি আমদানি সহনীয় পর্যায়ে রাখা ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্থিতিশীল রাখাকেও বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন অর্থমন্ত্রী।

এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকারের বিভিন্ন ও উদ্যোগ ও পরিকল্পনার কথাও অর্থমন্ত্রী তুলে ধরেন বাজেট বক্তৃতায়। বলেন, রফতানিমুখী শিল্পের সক্ষমতা বাড়ানো, রফতানি বহুমুখীকরণ, রফতানির জন্য নতুন বাজার অনুসন্ধান, দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক অগ্রাধিকার এবং মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি সইয়ের মাধ্যমে রফতানি বাড়াতে বেশকিছু উদ্যোগ নিয়েছে। অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরি এবং রফতানি বাড়াতে ভর্তুকি ও প্রণোদনা সরকার অব্যাহত রেখেছে।

আরও পড়ুন-

মূল্যস্ফীতি ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বমুখী পরিস্থিতির মধ্যেও স্বল্প আয়ের জনগোষ্ঠী যেন কম মূল্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য কিনতে পারে, সে জন্য সরকার টিসিবি’র মাধ্যমে পণ্য বিক্রি করছে বলে জানান অর্থমন্ত্রী। এ ক্ষেত্রে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে সামাজিক সুরক্ষা বেষ্টনীর আওতায় রাখার কথাও বলেন তিনি। আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধির কারণে আগামী অর্থবছরে জ্বালানি, প্রাকৃতিক গ্যাস, সার ও বিদ্যুৎ খাতে সরকারের যে ঘাটতি হবে, মূল্য বাড়িয়ে তা ভোক্তা পর্যায়ে শতভাগ চাপিয়ে দেওয়া হবে না বলেও জানান মুস্তফা কামাল।

এর আগে, দুপুরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বিশেষ বৈঠকে ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট অনুমোদন দেওয়া হয়। মন্ত্রিসভার অনুমোদনের পর ওই প্রস্তাবে সই করেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ।

সংসদে বাজেট উপস্থাপন প্রত্যক্ষ করছেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ

এরপর বিকেল ৩টায় অধিবেশন শুরু হলে স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট উপস্থাপনের জন্য অর্থমন্ত্রীকে আমন্ত্রণ জানান। অর্থমন্ত্রী সংসদে উপস্থিত রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের কাছে এই বাজেট উপস্থাপনের অনুমতি প্রার্থনা করেন। রাষ্ট্রপতি অনুমতি দিলে অর্থমন্ত্রী এই বাজেট উপস্থাপন শুরু করেন।

আরও পড়ুন-

সারাবাংলা/টিআর

২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বাজেট ২০২২-২৩ বাজেট উত্থাপন


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর